অনন্ত অসীম: লেখক, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী:
পাঠ্যপুস্তক হল একটি বই যা ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে অধ্যয়নের একটি শাখায় বিষয়বস্তুর একটি বিস্তৃত সংকলন রয়েছে। পাঠ্যপুস্তক সাধারণত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষাবিদদের চাহিদা মেটাতে তৈরি করা হয়। একটি জাতিকে সভ্য জাতিতে রূপান্তর করতে শিক্ষার যেমন বিকল্প নেই। তারজন্য প্রয়োজন গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ পাঠ্যপুস্তক। তাই স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে ‘সাম্প্রদায়িকীকরণ’ থেকে মুক্ত রাখতে আমাদের অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। এটা জাতি গড়ার জন্য বাধ্যতামূলক। আর এই পাঠ্যপুস্তক যারা তৈরি করবেন, তারা হতে হবেন বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাখাত কে ব্যবহার করে একটি ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী বরাবরই পাঠ্যপুস্তকে ‘সাম্প্রদায়িকীকরণ’ করতে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আদায়ে সবর রয়েছে। বিভিন্ন সময় পাঠ্যপুস্তকে ইসলাম বিরোধী প্রচ্ছদ ও অনুচ্ছেদ যুক্ত করলেও এবার রাষ্ট্র নিয়ে চক্রান্তের অংশ হিসেবে বিতর্কিত আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করেছে। বিগত বছরগুলোতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্পর্শকাতর আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার বন্ধের জন্য মিডিয়া, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহলকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিল। তাই ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী এবার কৌশল পরিবর্তন করে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে আদিবাসী শব্দটি বহুল প্রচার এবং দেশের বর্তমান প্রজন্মকে আদিবাসী হিসেবে পরিচয় করিয়ে ভবিষ্যৎ বিতর্কিত শব্দটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের মূল ভূখণ্ড হইতে দ্বিখণ্ডিত করতে একটি গভীর ষড়যন্ত্রে নেমেছে।
দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পাঠ্যপুস্তক সংস্কার করে। ২০২৫ সালের শিক্ষাবর্ষে নতুন পাঠ্যপুস্তক ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী দাখিল নবম ও দশম বাংলা ভাষা ব্যাকরণ নির্মিতি বইয়ের কভার পৃষ্ঠায় একটি গাছের শাখার মধ্যে ৫টি ধর্ম উল্লেখ করে! যথারীতি মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ থাকাটা স্বাভাবিক কিন্তু এখানে একটি ধর্মের স্থলে আদিবাসী শব্দ বা জাতিকে যুক্ত করা হয়েছে! পৃথিবীর ইতিহাসে প্রধান ৪টির ধর্মের বাহিরে বহু ধর্ম আছে। কিন্তু আদিবাসী নামে কোন ধর্ম আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি বিভিন্ন পেশাজীবী, ধর্মীয় গুরু, গবেষক, রাজনৈতিক বিদ ও ইতিহাসবিদের সঙ্গে কথা বলেছি, কেউ আমাকে আদিবাসী নামে ধর্ম আছে এমন তথ্য দিতে পারেনি। সবাই মতামত দিয়েছে আদিবাসী হিসেবে ধর্ম নেই কিন্তু জাতি আছে, যাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, আমাদের দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দুরে। এরা হচ্ছেন, ব্রাজিল আমাজন আদিবাসী, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী, রেড ইন্ডিয়ান ও আফ্রিকার কিছু জনজাতি। পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী শব্দ অন্তর্ভুক্তি দেশের বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন তারা। কারণ আদিবাসী এমন একটি শব্দ যার রয়েছে বহু বিতর্কিত ও স্পর্শকাতর দিক। এটি বাংলাদেশের মত ছোট দেশে ব্যবহার বা সাংবিধানিক স্বীকৃতি রাষ্ট্রকে দ্বিখণ্ডিত করতে ভূমিকা রাখবে।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামছুল ভূঁইয়া বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে কখনও কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এরপরও কেন একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে সরব তা বোধগম্য নয়।
আদিবাসী শব্দটি কেন বিরোধিতা? আর কথিত আদিবাসীদের বাস্তবিক অর্থে পরিচয় কী-
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে দাবি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং চুক্তির (খ) খণ্ডের ১ নম্বর ধারায় জেলা পরিষদের আইনে উল্লেখ করা হয় যে ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকবে।
২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩(ক) ধারায় সংস্কৃতি সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বলা হয়, রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আদিবাসী শব্দ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে সরকার তার অবস্থান বারংবার তুলে ধরেছে এবং গত ২০২২ সালের ১৯ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শেখ শামছুর রহমান স্বাক্ষরিত স্মারক নং-১৫.০০.০০০০.০২৪.১৮.১৪.৫৯৬ মূলে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে সংবিধান সম্মত শব্দ ব্যবহারের নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত টকশোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করেছে।
আদিবাসী শব্দটি নিয়ে যেহেতু সাংবিধানিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে সেহেতু এটি ব্যবহার আমাদের দেশের জন্য যথার্থ নয়।
তদুপরি পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করার ফলে দেশের আপামর মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে এটি পরিবর্তনে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে আইনের আওতায় আনার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানিয়েছেন।