গত পাঁচ দশকে পাহাড়ে সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ি সশস্ত্র ৬টি সন্ত্রাসী সংগঠন। জাতির অধিকার দাবি আর নানা আদর্শ নিয়ে তাদের উৎপত্তি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) মূল সন্তু থেকে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রসিত, জেএসএস মূল থেকে জেএসএস সংস্কার, ইউপিডিএফ প্রসিত থেকে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক বর্মা, মগ পার্টি ও বম পার্টি। এই সংগঠনগুলো জনসমর্থন, অর্থ সহায়তায় পেতে সহজসরল উপজাতিদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, স্বকীয়তা, অধিকার ও স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখিয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে মিথ্যে স্বাধীনতার গল্প শুনিয়েছে। এভাবেই গত পাঁচ দশক সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক লক্ষাধিক পাহাড়ি পরবর্তীতে পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায় থেকে চাঁদা আদায় করে আসছে। তাদের এই চাঁদাবাজিতে পিষ্ট পাহাড়ি জনপদ। চাঁদা উত্তোলন, ভাগবাটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ নেমেছে সংগঠনগুলো। গত কয়েক দশকে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য প্রশ্নে রক্তারক্তি সংঘর্ষে প্রাণ গেছে অনন্ত দুই হাজারের মত। অপহরণ ও আহত হয়েছে অগণিত। সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেএসএস সন্তু গঠন হয়েছে প্রায় ৫৩ বছর। এই ৫৩ বছরে সরকার ও জেএসএস মধ্যকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ছিল জেএসএস এর সবচেয়ে বড় অর্জন। চুক্তিতে পাহাড়ি জনগণের কল্যাণ সাধিত হয়েছে। এ অর্জনে থেমে থাকেনি জেএসএস সন্তু। ছিল উচ্চ আকাঙ্ক্ষা। চুক্তির ২৭ বছরে দাঁড়িয়ে পাহাড়ে এখনও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাস, খুনখারাপি, চাঁদাবাজি করে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করে রাখছে জেএসএস। কথিত জুমল্যাণ্ডের স্বপ্ন দেখিয়ে হাজার হাজার পাহাড়ি যুবকদের জীবনকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে। ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আজ ২৬ বছর। এ পর্যন্ত তাদের অর্জন নেই। স্বায়ত্তশাসন আর স্বাধীনতার মিথ্যে গল্প শুনিয়ে পাহাড়ি যুবকদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করেছে। জেএসএস সংস্কার প্রতিপক্ষ দমনে প্রতিশোধের নেশায় চোরাগোপ্তা হামলা আর অনিশ্চিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আছে। এটি সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ১৫ বছর। একই তালে আছে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক বর্মা। প্রায় ৭ বছর হয়েছে যাত্রার কিন্তু সাফল্য শূন্য। মগ লিবারেশন আর্মি বা মগ পার্টি চাকমাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য অভিযোগ তুলে মারমা জাতির কল্যাণে অধিকারের কথা বলে মারমা যুব সমাজকে আজ সন্ত্রাসে পতিত করেছে। প্রায় ১০ বছর ধরে সক্রিয় কিন্তু প্রকাশ্যে আসে ৪/৫ বছর হবে। স্থানীয়রা মনে করেন, মগ পার্টি দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদের গতিধারা প্রসারিত করেছে। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) স্থানীয়ভাবে পরিচিত বম পার্টি নামে। কুকি জনগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে বম পার্টি চাকমা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সর্বক্ষেত্রেই বৈষম্যের অভিযোগ তুলে স্বপ্নের কুকি রাজ্য গঠনে দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। এই সংগঠন সৃষ্টির তথ্য স্পষ্ট নয়। ধরে নেয়া যায়, ২০০৮ সালে কেএনডি সামাজিক সংগঠনের নামে আত্মপ্রকাশ করে পরবর্তীতে ২০২১ সাল কাচিন গিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ফিরে আসে রুমা, থানচিতে। ২০২২ সালের অক্টোবরে তারা প্রকাশ্যে আসে।
স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, ৬টি আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনে কমপক্ষে ১০ হাজার পাহাড়ি যুবক কোন না কোনোভাবে জড়িত। এর মধ্যে সশস্ত্র গ্রুপে আছে অন্তত ৫ হাজার।
এসব পাহাড়ি যুবকদের ক্ষমতা প্রদর্শনের লোভ, অর্থের লোভ আর স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখিয়ে সংগঠনে নিযুক্ত করে উগ্র সাম্প্রদায়িক পাহাড়ি নেতারা। তাদের মস্তিষ্ক এমনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদেরকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করেছে। দিনের পর দিন তাদের গল্পকাহিনি বলে বলেই অপরাধ জগতে নিয়োজিত করেছে। তারা মানুষ, চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ ও নানা অপরাধে জড়িয়ে গেছে। দিনশেষে দেখা গেছে তাদের অপূর্ণতা থেকেই যাচ্ছে। বৃদ্ধদের মত একসময় তাদেরও সময় ফুরিয়ে যাবে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের স্বাধীনতা বা আলাদা ভূখণ্ড পাওয়া হবে না। এই অনুভব তাদের ভিতরে এখন কাজ করে।
পাহাড়ি যুবকেরা আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র শাখায় নিয়োজিত আছে পাহাড়ের গহিন এলাকার বিভিন্ন ক্যাম্প ও ঝুপড়িতে। এবং আবার নিয়োজিত আছে রাজনৈতিক শাখায়। তাদের বর্তমান অবস্থা, দাবিদাওয়া ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সরাসরি, মুঠোফোনে বা বাহক মারফত কথা হয়েছে। কথা হয়েছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে এমন কয়েকজনের সঙ্গেও। তাদের মধ্যে হাজারের বেশি যুবক স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আছেন। তারা বলছেন, সন্ত্রাসী জীবনের পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা কঠিন হতে পারে এবং মুক্তি পেতে সময় লাগতে পারে। তারা এমন একটি পরিস্থিতিতে আছেন যেখান সার্বক্ষণিক নজরদারিতে।
আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দলের অন্ধকার জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন, ছদ্মনাম কমল বিকাশ চাকমা, অর্ক চাকমা ও জিমিত চাকমা। তাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে আঞ্চলিক দলে থাকা মানসিক কষ্ট। এখানে যারা আছেন তাদের প্রতিদিন দুঃখ, মেজাজ পরিবর্তন, বিরক্তি, ফ্ল্যাশব্যাক এবং কান্না অনুভব হয়। তারা যখন হাসে তখন তারা অপরাধী বোধ করে। তারা এখন বুঝতে পারছে যে, তারা অপরাধ জীবনে প্রবেশ করেছে। ক্ষমতা ও অর্থলোভী পাহাড়ি নেতারা তাদেরকে অন্ধকার জীবনে ধাবিত করেছে। তারা যে-সব অপরাধ করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। রাষ্ট্র কী তাদের মেনে নিবে আর সংগঠন কী তাদের মুক্তি দিবে এমন চিন্তায় তারা বিভোর।
সশস্ত্র শাখায় আছেন, ছদ্মনাম প্লাবন চাকমা, বিন্দু চাকমা, কালাময় চাকমা ও প্রীতি চাকমা জানান, তারা মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জে আছেন। কারণ তাদের কেউ কেউ মানসিকতা ভাবে অসুস্থ। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত পরিবেশ তাদের নেই। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছেন না। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন তাদের থেকে অনেক দুরে। সামাজিক বন্ধন নেই। সবসময় বন্দিশালায় সময় কাটাচ্ছেন। সামগ্রিক অর্থে জেলখানা তাদের সশস্ত্র জীবন থেকে অনেক ভালো।
মুক্তির চিন্তা করতে এবং পরিকল্পনা করতে অসুবিধা হতে পারে এবং মনে হতে পারে যে জীবন শূন্য এবং অর্থহীন। এও তাদের ভাবনা, স্বাভাবিক জীবনে আসার পর সামাজিক চ্যালেঞ্জ: আত্মীয়-স্বজন বন্ধু এবং সহকর্মীরা দুঃখ এবং পুনরুদ্ধার করতে যে সময় লাগে তা বুঝতে পারে না। রাষ্ট্র উদ্যোগ নিলে তারা ফিরে আসতে পারেন। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের সহানুভূতি, ক্ষমা প্রদর্শন ও পাহাড়ে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা। তারা বলেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাওয়া পাহাড়ি যুবকদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। হাজারের অধিক হবে। সমস্যা হচ্ছে, তারা যেখানে আছে সেখানে ঘন জঙ্গল, গহিন অরণ্য এলাকা। নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। সবসময় নজরদারির মধ্যে থাকেন। কোনোভাবেই পালিয়ে আসলেও নিরাপদে থাকার জায়গা নেই। আঞ্চলিক দল তাদের খুঁজে হত্যা করবে। আগে যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন, তাদের হত্যা করেছে! এখন কী করবেন তা তারা জানেন না। তারা অনেক হতাশাগ্রস্ত কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কারণে। মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে পরিবার, সামাজিক ও স্বাধীন জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে আঞ্চলিক সংগঠনের স্বার্থকবাজ অর্থলোভী নেতারা। এদের প্রলোভনে পড়ে দীর্ঘদিন রাষ্ট্র বিরোধিতা করে তারা আজ রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী। অনেকেই মামলার আসামি। তাদের অন্ধকার জীবন। তাই তারা হতাশায় নিমজ্জিত। তারা একটি বার্তা দিয়েছেন পাহাড়ি যুবকদের উদ্দেশ্যে, কেউ যেন পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনের মিথ্যা স্বপ্ন আর গল্পে অন্ধকার জীবনে প্রবেশ না করেন। এখানে সবই মিথ্যা, অধিকারের নামে ধোঁকাবাজি।
অনন্ত অসীম, লেখক, ব্লগার, সাংবাদিক, গবেষক, তথ্য বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মী পার্বত্য চট্টগ্রাম।