উপজাতি ও আদিবাসী বিতর্ক: বাংলাদেশের বাস্তবতা এবং করণীয়।

0
ছবি: সংগৃহীত চাক উপজাতি

 

অনন্ত অসীম
হিল নিউজ বিডি

বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসী বিতর্ক একটি সংবেদনশীল এবং বহুমুখী ইস্যু। এই বিতর্ক শুধু তাত্ত্বিক নয়; বরং এটি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এই অঞ্চলের উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা করা হয়েছিল। তবে আদিবাসী পরিচয় দাবি এবং তা ঘিরে রাজনৈতিক ও বৈদেশিক হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আদিবাসী দাবিকে কেন্দ্র করে নানা সমস্যা দেখা দেয়, যার মূলে রয়েছে আন্তর্জাতিক আইনের অস্পষ্টতা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। বাংলাদেশেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া অভিবাসীদের প্রথমে উপজাতি এবং পরে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাপ দেওয়া হয়। এই দাবি ঐতিহাসিক ও গবেষণালব্ধ তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং ন্যায্য শর্ত পূরণ করে না।

বাংলাদেশে একটি বিতর্কের জায়গা হলো, অনেক গোষ্ঠী যারা ব্রিটিশ বা পাকিস্তান শাসনামলে শরণার্থী হিসেবে এসেছিলেন, তারা কীভাবে “আদিবাসী” হওয়ার দাবিদার হতে পারেন। এছাড়া বাংলাদেশের প্রধান জনগোষ্ঠী বাঙালিদের ঐতিহাসিক ভূমি এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস উপেক্ষা করে আদিবাসী দাবি তোলা অনেকক্ষেত্রেই বিতর্কিত। এমনটা মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।

আদিবাসী দাবি করা উপজাতি নেতাদের দাবি: রাস্ট্রের মূল জনগোষ্ঠী থেকে চেহারা, ভাষা ও সংস্কৃতি ভিন্ন হলে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য! জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) ও আদিবাসী ফোরামের দাবিও একই। এই দাবিতে বিশ্ব আদিবাসী দিবসে তাদের ঢাকঢোল পিটিয়ে দিবসটি পালন করতে দেখা যায়। এছাড়াও স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আদিবাসী শব্দ যুক্ত ব্যানার ফেস্টুন লক্ষণীয়।

বহু বছর থেকে উপজাতি পরিচয়ে রাস্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও কোটা ভোগী উপজাতিরা ২০০৭ সালের পর নিজেদের আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। এই নিয়ে পক্ষ বিপক্ষ অবস্থানে বাড়ছে নানা বিতর্ক। বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে এই নিয়ে চরম বিরোধী তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক উপজাতি আধিবাসী বিতর্ক সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে।

ছবি: পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী/উপজাতি

উপজাতি ও আদিবাসী বিতর্ক: সংজ্ঞা ও বাস্তবতা:

১. আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) কনভেনশন ১৬৯-এ উপজাতি (Tribal) ও আদিবাসী (Indigenous) জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
উপজাতি (Tribal): যারা একটি রাষ্ট্রের অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়ার পরিবর্তে ভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
আদিবাসী (Indigenous): যারা একটি ভূখণ্ডের প্রথম অধিবাসী এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।
বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অভিবাসিত। তারা আদিবাসী নয়; বরং আইএলও সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি।

২. সংবিধান ও সরকারি অবস্থান:
২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে এ দেশে কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই। সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী/উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

৩. পার্বত্য চট্টগ্রামের জটিলতা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি গোষ্ঠী নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিয়ে আঞ্চলিক শাসন ছাড়িয়ে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি করছে। এ দাবি ঐতিহাসিক, সাংবিধানিক ও নৈতিকভাবে অসঙ্গত।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুক্তির বিশ্লেষণ:
চেহারা বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য- কোনো গোষ্ঠীর ফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্রের মূল জনগোষ্ঠীর থেকে ভিন্ন হতে পারে, তবে এটি একমাত্র যোগ্যতা নয়। এটি জীববৈচিত্র্যের অংশ এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভিত্তি নয়।
ভাষা: ভাষাগত ভিন্নতা গুরুত্বপূর্ণ, তবে অনেক সময় ভাষার উৎস এবং তার বিকাশের ইতিহাস নির্ণয় করা প্রয়োজন। অনেক উপজাতি ভাষা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আগত বা বহিরাগত।
সংস্কৃতি: সংস্কৃতি ভিন্ন হতে পারে, তবে আদিবাসী হিসেবে দাবি করার জন্য সেই সংস্কৃতির শিকড় ঐ ভূমিতে ঐতিহাসিকভাবে প্রোথিত থাকা প্রয়োজন।

উপজাতি ও আদিবাসী বিতর্ক অবসানে করণীয়:

সঠিক গবেষণা ও তথ্য উপস্থাপন-ঐতিহাসিক তথ্য, সাংস্কৃতিক ইতিহাস এবং জনসংখ্যার গতিবিধি সম্পর্কে গভীর গবেষণা। আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্টীকরণ: আদিবাসী সংজ্ঞা এবং তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি নির্ভুল গাইডলাইন তৈরি করা। সংলাপ ও বোঝাপড়া: উপজাতি এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে সমঝোতা তৈরি এবং সমস্যা সমাধানে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা। এমন বিতর্কগুলো সমাধান করতে গেলে নিরপেক্ষ ও ইতিহাস, ঐতিহাসিক গবেষণা ও সুদীর্ঘ বসবাসের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

গুরুত্বপূর্ণ হলো:

১. সংবিধানের বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়ন
সংবিধান অনুযায়ী, উপজাতি জনগোষ্ঠীকে তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করতে সহায়তা করা হবে।
২০১১ সালের সরকারি ঘোষণা ও ২০২২ সালের প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়নে গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।

২. অপপ্রচার ও বিদেশি হস্তক্ষেপ রোধ:
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়নের উপর নজরদারি বাড়াতে হবে।
বিদেশি গোষ্ঠীর মাধ্যমে আদিবাসী স্বীকৃতি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি বন্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন।

৩. পার্বত্য এলাকার শান্তি প্রতিষ্ঠা:
বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম বন্ধে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
উপজাতি এবং পার্বত্য বাঙালিদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা।

৪. সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি:
পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে তোলা।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন দূর করতে হবে।

৫. চুক্তির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন:
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির সব ধারা কার্যকর করা।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত সুবিধা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করা এবং তা বাঙালিদের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ করা।

উপজাতি ও আদিবাসী বিতর্ক সমাধানে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা। পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য দূর করতে হলে বৈধ অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবিলায় শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি, উন্নয়ন এবং সহাবস্থানের ভিত্তি স্থাপন সম্ভব।

আগের পোস্টবাংলাদেশে পাচারের জন্য মিজোরামে প্রস্তুত অস্ত্রের চালান আটক: ইউপিডিএফ এর সম্পৃক্ততা।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন