বান্দরবানে ভ্রমণে গিয়ে উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হওয়ার সেই গল্প।

0
ছবি: সংগৃহীত সাকা হাফং

কারিম শাওন

দিনটা ২০২২ সালের ৩ মে, মঙ্গলবার। রাতের বাসে করে রওনা হই বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। ৪ তারিখ ভোরে চকরিয়া। পৌঁছাই। চকরিয়া থেকে আলিকদম হয়ে থানচি বাজারে যাই। এরপর সেখান থেকে ১৩ কিলো নেমে হেঁটে কাইতন পাড়া যাই। এরপর সিম্পলাম্পিং পাড়া হয়ে বিকেলে তাজিংডং সামিট করি। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে থান্দুই পাড়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করি। রাতে থান্দুই পাড়ায়ই থাকি। ৫ তারিখ সারাদিন এই পাড়াতেই। সন্ধ্যায় খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ৭:১০ এ হাঁটা শুরু করি। উদ্দেশ্য রেমাক্রি খাল।

থান্দুই পাড়া থেকে ১০-১৫ মিনিট নেমে একটা খাড়া পাথুরে পাহাড় পুরোটা উঠে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। পরের পথটুকু ১৫ মিনিট নামলেই রেমাক্রি খাল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে টর্চ লাইটের আলোতে সারিবদ্ধভাবে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা ২৩ জনের দলে আমি মাঝাখানে ছিলাম। আবছা আলোতে হঠাৎ সামনে দেখি আমাদের দলের হোস্টের পথ রোধ করে মুখোশ পড়া (গামছা পেচানো ছিল) কয়েকজন লোক দাঁড়ান। হাতে বন্দুক, ধারাল ড্যাগার, লাঠি। হোস্টকে ওরা লাঠি দিয়ে আঘাত করা শুরু করলে পেছনের আমরা বুঝতে বাকি রইল না যে এরা কারা। সাথে সাথে উলটোদিকে ঘুরে দৌড় দিই। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সন্ত্রাসীদের দু’জন আমাদের পিছু নিল। একসময় থেমে যাই। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আমাদের সবাইকে এক জায়গায় এনে দাঁড় করায়। কয়েকজনকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে।

সামনে গিয়ে দেখতে পেলাম ৪/৫ জন সন্ত্রাসী। তিনজনের হাতে একনলা বন্দুক। দু’জনের হাতে ড্যাগার। যেখানে দাঁড়ানো ছিলাম সেখান থেকে অনেক দুরে নিপিউ বিজিবি ক্যাম্পের ৪টা আলো দেখা যাচ্ছিল। তাই ওরা আমাদের টর্চলাইটগুলো নিভিয়ে দিয়ে আমাদেরকে আরও একটু নিচের দিকে যেতে ইঙ্গিত দেয়। গরু-ছাগলের মতো জড়ো হয়ে অন্ধকারে পাহাড়ি পথ ধরে নিচের দিকে নামছি সবাই। কোথায় যে পা পরছে কোনো হুশ নেই। নামিয়ে একটা জায়গায় আবার দাঁড় করায় আমাদের। এখান থেকে এবার নিপিউ বিজিবি ক্যাম্পের আলোগুলো আর দেখা যাচ্ছিল না। ক্যাম্পটা পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল।

এবার ওরা সবার পকেট চেক করে মোবাইল মানিব্যাগগুলো নেওয়া শুরু করে। এরপর সবাইকে বসতে বলে। এর মধ্যে হোস্টকে কয়েক ধাপে বেদমভাবে পেটায়, ওনার বুকে লাথি দেয়, হাত ড্যাগার দিয়ে কেটে ফেলতে চায়। আমার গলায় ড্যাগার ধরে দু’বার। বুকে ও পেটে ড্যাগার ঢুকিয়ে দিতে চায়। মাথায় ড্যাগার দিয়ে আঘাত করে। এরপর লাঠি দিয়ে দুই হাতে দুই বার সজোরে আঘাত করে। ওদেরকে বলি, এখানে আর আসব না। এরপর সরে অন্যজনকে গিয়ে ধরে। সবার মুখ থেকে একই কথা বলায় যে, “ভুল হয়ে গিয়েছে, আমরা এখানে আর আসব না।”

এটা ছিল প্রশাসন কর্তৃক নিষিদ্ধ সাকা হাফং ট্রেইল। বান্দরবানের একেবারে শেষ সীমানা। এখানে গেলে যেতে হবে সেনাবাহিনী ও বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে। তারা জানলে কঠিন শাস্তি দিয়ে থানচিতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

সাকা হাফং মদক রেঞ্জের (পর্বতশ্রেণী) একটা পর্বত। উচ্চতায় ৩৪৬৫ ফিট। কারও মতে ৩৪৮৫ ফিট। যদিও সরকারি হিসেব অনুযায়ী তাজিংডংকে (২৫২৮ ফিট) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু গুগল ম্যাপ, গুগল আর্থ, ইউ এস এবং রাশিয়ান টপোগ্রাফিকাল ম্যাপ, অন্যান্য অভিযাত্রীদের জিপিএস রিডিং অনুযায়ী সাকা হাফং পাহাড়ই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া।

এই পাহাড়ের অবস্থান মিয়ানমার সীমান্তে। নেটওয়ার্কের বাহিরে। একেবারে দূর্গম এলাকা। জঙ্গল আর জঙ্গল। দেড়-দুইশ বছরের পুরনো মোটা-মোটা গাছ, দানবাকৃতির পাহাড়ের মাঝখানে মাঝখানে পড়ে থাকা একতলা ঘরের সমান বিশাল বিশাল পাথরের খণ্ড, ঝরণা, খুম, পাহাড়ের গা বেয়ে বয়ে চলা ঝিরি, বিশাল পাথুরে খাল। এই সৃষ্টিজগতটা যে কী রকমের অদ্ভুত, সেটা পাহাড়ের গহীনে না গেলে কস্মিনকালেও কেউ জানবে না। পাহাড়ের ঘোরার নেশা যাদেরকে একবার পেয়ে বসে তারা এসব ঝুঁকি মাথায় নিয়েই পাহাড়ের গহিনে যায়।

এরপর আমাদের সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেমাক্রি খালের দিকে যেতে বলে। সময় তখন আনুমানিক রাত ৮:৪৫ বা ৯ টা। এরমধ্যে আমাদের একজনকে ডেকে ৩টা মোবাইল ফিরিয়ে দেয়। ৪টা মোবাইল নিয়ে যায়। আমার মোবাইলটা কমদামি হওয়ায় তখনই মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কুড়িয়ে নিয়ে নিই। আমাদের ভয় হচ্ছিল ওরা আমাদেরকে উলটো রাস্তায় না পাঠিয়ে রেমাক্রির দিকে— অর্থাৎ আরও গভীরে কেন যেতে বলে। ওদের একজনের হাতে ওয়াকিটকি ছিল। ওটা দিয়ে ওরা অন্য সন্ত্রাসী দলের সাথে কথা বলছিল। আমাদের ভয় হলো, হয়তো সামনে গেলে ওদের অন্যান্য সদস্যদের সাথে মিলে এরপর আমাদেরকে অপহরণ করবে বা সবার কাছ থেকে সবকিছু খুঁজে কেড়ে নেবে। কারণ আমরা ছিলাম ২৩ জন। ৬ জন মিলে ২৩ জনকে নিয়ন্ত্রণ করাটা সহজ ছিল না ওদের জন্য।

যাহোক, আমরা আর সামনে আগাইনি। প্রথম কারণ হলো, আমাদের একজন সদস্যকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হয়তো ঝোপে কোথাও লুকিয়েছিল। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, সামনে ওদের আরও সদস্য থাকতে পারে। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আশেপাশের কোনো একটা ঝোপে রাতটুকু কাটিয়ে ভোরবেলা আমাদের মিসিং সদস্যকে খুঁজে বের করে উল্টোপথে থানচি চলে যাব; সাকা হাফং যাব না। তখন আমরা মাঝারি আকৃতির একটা পাহাড়ের চূড়ায়। আমাদের চারপাশে বড়ো বড়ো পাহাড়। অর্থাৎ একটু আগে যেই পাহাড়টায় উঠে সন্ত্রাসীদের কবলে পড়েছি, সেখানেই অবস্থান করছি আমরা। রেমাক্রি খালের দিকেও নামছি না। আবার থান্দুই পাড়ার দিকেও যাচ্ছি না।

তো পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের চলার পথের একটু আড়ালে একটা জায়গা নির্ধারণ করে মাটিতে পড়ে থাকা কাঁটাযুক্ত ডালপালার ওপরেই যে যেভাবে পারলাম শুয়ে পড়লাম। সবাই চুপচাপ শুয়ে আছি। কেউ টুঁশব্দটি পর্যন্ত করছি না। প্রয়োজন হলে ফিসফিস করে কথা বলছি। আলো তো জ্বালাচ্ছিই না। কোথাও কোনো একটা জোনাকি পোকা জ্বলে উঠলে ভয় পেয়ে যাই। মাঝে মাঝে একটা হুতুম পেঁচা ডেকে ওঠে। ঝিঁঝি পোকার আওয়াজও বন্ধ। চারদিকে সুনসান নীরবতা। এভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ৩ ঘন্টার বেশি কেটে গেল।

রাত তখন আনুমানিক ১২:৩০ বা ১ টা। দু’একজন ছাড়া কারো চোখে ঘুম নেই। সবাই ভয় ও উৎকন্ঠা নিয়ে ভোর হওয়ার অপেক্ষায়। হঠাৎ দেখি আমাদের বামদিকের পাহাড় থেকে (থান্দুই পাড়া থেকে বের হয়ে রেমাক্রি খালের দিকে যাওয়ার জন্য যে পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে আমরা সন্ত্রাসীদের কবলে পড়েছিলাম।) ১০/১২ টা টর্চ লাইটের আলো আমাদের দিকে নেমে আসছে ধীরে ধীরে। এরই মধ্যে দেখি ডান দিকের পাহাড়ের ওপর থেকে নীল একটা আলো সংকেত দিচ্ছে। সবাই বুঝলাম এগুলো ওই সন্ত্রাসীরাই। আরো দলবল নিয়ে এসেছে। কারণ আমরা ওদের কথা মতো সামনে আগালে ৩ ঘন্টায় ওদের অন্য দলের সামনে চলে যেতাম। যেহেতু অন্য সন্ত্রাসী দলটা আমাদেরকে পায়নি, এরমানে আমরা ওদের দু’দলের মাঝখানে আছি। তাই আমাদেরকে ধরতে আগের সন্ত্রাসী দলটা দল ভারি করে এসেছে। তখন আমাদের প্রত্যেকের অবস্থা কী, সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না আসলে। ধীরে ধীরে আলোগুলো সামনে আগায় আর আমাদের সবার হৃদকম্পন আরও বাড়তে থাকে। আমি মনে মনে একবার ভাবলাম এখান থেকে আরো গভীরে লুকোই। কিন্তু কোথায় যাব। ওরা অন্ধকারেই খুঁজে বের করে ফেলবে। এসব জায়গা ওদের চেনা।

আমি একবার ভাবেছিলাম ওনারা হয়তো সেনাবাহিনী বা বিজিবি সদস্যদের দল। কোনোভাবে খবর পেয়েছে যে আমরা সন্ত্রাসীদের কবলে পড়েছি। তাই উদ্ধার করতে এসেছে। কারণ, যখন আমাদেরকে জিম্মি করে তখন অনেক দূরে নিপিউ বিজিবি ক্যাম্পের পাশে একটা বড়ো ফ্লাড লাইট হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল। এ রকম ভাবনা আমার মধ্যে আসার একটা যৌক্তিক কারণও আছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবির প্রতিটি ক্যাম্পে সারভেইলেন্স টাওয়ার থাকে। এখানে দাঁড়িয়ে তারা অত্যাধুনিক দূরবিনের সাহায্যে দিন-রাত আশেপাশে নজর রাখে। আমরা সন্ত্রাসীদের কবলে পড়ার আগে যখন পাহাড় থেকে টর্চ লাইটের আলো জ্বেলে রেমাক্রি খালের দিকে নামছিলাম, আমাদের ২৩ জনের ২৩ লাইটের আলো নিপিউ বিজিবি ক্যাম্প থেকে সরাসরি দেখতে পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক; যেহেতু আশেপাশে আর কোনো আলো ছিল না। নিপিউ বিজিবি ক্যাম্পের ৪টা আলো আমরাও সরাসরি খুব স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম। তাছাড়া এখন যে দলটা আমাদের দিকে নেমে আসছে এদের টর্চ লাইটের আলোগুলোও গভীর জঙ্গলের ভেতরে জ্বলজ্বল করছিল। তো আমার মনে হলো, আমরা যখন হাতে লাইট জ্বেলে উলটোদিকে ঘুরে দৌড় দিয়েছিলাম, এটা নিপিউ বিজিবি ক্যাম্প থেকে বিজিবি সদস্যরা দেখেছে। এরপর আমাদের সব আলো বন্ধ। এরপর যেহেতু আর কোনো আলো তারা দেখতে পাচ্ছিল না, তাই হয়তো তখনই অভিযানে বের হয়েছে। আমরা যেখানে ছিলাম নিপিউ বিজিবি ক্যাম্প থেকে ৩৬ কিলো রাস্তা দিয়ে আসলেও ঘন্টা দু’তিনেক লাগার কথা। কারণ কিছু পথ পাকা রাস্তা দিয়ে এসে থান্দুই পাড়ায় ঢুকতে হবে। এরপর এখনকার এই পাহাড় দিয়ে নিচে নেমে আমাদের দিকে আসতে হবে। কিন্তু ডান দিকের পাহাড়ে নীল আলোর সংকেত দেখার পর সেই আশাটুকুও নিভে গেল আমার।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়লাম মনে হলো। সামনে শুধুই অনিশ্চয়তা। জীবনে কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি। বিপদ সামনে এগিয়ে আসছে। অথচ কোথাও পালাতেও পারছি না। বামে অনেকগুলো আলো, ডানে ওদের আরেক দল। সামনে ও পেছনে পাহাড়ের খাজ। পালানোর জায়গা নেই। নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। সবাই শুয়ে। মাথাটা একটু ওপরে তুলে দেখছি। আমি ফিসফিস করে সবাইকে বললাম, “ওরা কাছে আসলে একবারে চিত হয়ে শুয়ে যাবেন সবাই”। একসময় সবাই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি আর চট্টগ্রাম মেডিকেলের একজন ডাক্তার মাথাটা হালকা উঁচু করে দেখছি। আর খানিকটা দূরে আমাদের হোস্ট ও আরও একজন একইভাবে ওই দলটার দিকে লক্ষ্য রাখছিল। কাছে আসতে বুঝলাম দলের মানুষ ২০ জনেরও অধিক। দলটা আরও একটু কাছে আসলে বুঝলাম এরাও ট্যুরিস্ট। কলিজায় পানি ফিরে আসল। ২৭ জনের আরও একটা দল আজকে সন্ধ্যায় থান্দুই পাড়ায় ঢুকেছিল। ওনারা থান্দুই পাড়ায় ৩/৪ ঘন্টা ঘুমিয়ে রাতেই সাকা হাফংয়ের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে।

আমাদের মিসিং মেম্বারটা একটা ঝোপে লুকিয়ে ছিলো। পরে ওনার মুখ থেকে শুনলাম, উনি ২৭ জনের দলকে অনেকখন অবজার্ভ করে এরপর ঝোপ থেকে বের হয়ে সাহায্য চেয়েছে। মিসিং মেম্বারটা তখনও জানে না যে আমরা আরও সামনের দিকে অপেক্ষা করছি। ২৭ জনের ট্যুরিস্ট দলটা যখন আমাদেরকে অতিক্রম করে চলে যাচ্ছিল, তখন আমাদের হোস্ট ঝোপের আড়াল থেকে ওই দলের হোস্টের নাম ধরে ডাকেন। ঝোপটা একটু ওপরের দিকে ছিল। আলো জ্বালিয়ে সবাই দ্রুত নিচে নেমে আসি। এরপর টর্চ লাইট নিভিয়ে ওনাদেরকে ঘটনা খুলে বলার পর, ওই গ্রুপের হোস্ট বললেন, “আমরা ২৭ জন সামনে থাকব। এরপর আপনাদের ২৩ জন থাকবেন। আপনাদের দলের প্রথমে থাকবে আপনাদের হোস্ট। আর দলের শেষে যে থাকবে তাকে অনেক সাহসি হতে হবে।” এই বলে আবার হাঁটা শুরু হলো। ৭/৮ মিনিট পরেই রেমাক্রি খালের কাছে নামলাম। এরপর প্রায় ৩ ঘন্টা রেমাক্রি খাল ধরে হাঁটতে হয়েছে। হাঁটার সময় একটা সমস্যা তৈরি হলো। সবার শেষে কেউ থাকতে চায় না। সবাই আগে আগে চলতে চায়। কারণ ভয়। যদি দলছুট হয়ে গেলে পেছন থেকে আবার কোনো বিপদ ধরে বসে। কারণ, পুরো জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাছাড়া যত সামনে যাচ্ছি তত গহিন অরণ্যের ভেতরে ঢুকছি। সবাই চুপচাপ হেঁটে চলছি।

৪টা বা ৪:১৫ নাগাদ রেমাক্রি খাল শেষ হয়ে নিপিউ জঙ্গলে ওঠা শুরু করি। আধাঘন্টা হাঁটার পর আকাশ কিছুটা ফর্সা হওয়া শুরু হলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যে চারপাশ মোটামুটি ভালই আলোকিত হয়ে গেছে। এখন টর্চ লাইটের আলো ছাড়াই হাঁটা যাচ্ছে। এবার সবাই একেবারে নির্ভয়। কারণ দিনের আলোতে সাকা হাফংয়ের ট্রেইলে সেনাবাহিনীর কাছে ধরা পড়লেও জানে মরার ভয় নেই। অবশেষে পরের দিন সকাল সাড়ে ১০টায় সাকা হাফংয়ের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ।

এরপর এমন ঘটনা বান্দরবানের আরো অনেক জায়গায় হয়েছে। আমিয়াখুমের মতো প্রশাসন অনুমোদিত স্পটে ট্যুরিস্টদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে লাখ দুয়েক টাকা, ২০/২২টা মোবাইল নিয়ে গেছে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। সাকা হাফংয়ের ট্রেইলে গত কয়েক দুই বছরের দুটো ঘটনা ঘটেছে এমন। আন্ধারমানিকের দিকে ট্যুরিস্টদের বেঁধে রেখে নির্যাতন করার ঘটনাও ঘটেছে। এই তো সেদিনও সাজেক ও কেওক্রাডং যাওয়ার পথে ট্যুরিস্টদের গাড়িতে লক্ষ্য করে গুলি করেছে। যেগুলো জেনেছি, সেগুলো বললাম। না জানা এমন অনেক ঘটনা আছে। বছর দশেক আগে বান্দরবানে মুন্না ও জুবায়ের নামে দু’জন ট্যুরস্টের ভ্রমণ এবং অপহৃত হওয়ার পর তাদের লাশ খুঁজে না পাওয়ার কাহিনি বান্দরবানের অফট্রেইলে যারা যায়, তারা মোটামুটি শুনেছে।

এবার কিছু হিসেব মেলাই।

(১) ওই ৫ জন আসলে কারা ছিল?

আমাদের গ্রুপের কয়েকজন বলছিল, ওনারা সেদিন দিনের বেলা থান্দুই পাড়ার নিচে একটা ঝিরি থেকে গোসল করে ওঠার সময় কয়েকটা ছেলে তাদেরকে কিছু প্রশ্ন করেছিল। সন্ত্রাসী দলের লোকগুলোর শরীরের গড়ন এবং জামাকাপড় নাকি সেরকমই ছিল। আমার ধারণা এই ৫ জন ওই পাড়ারই। কারণ, এমন গভীর জঙ্গলে বাহিরের কেউ এসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করবে না। তাছাড়া জেএসএস, ইউপিডিএফ, কেএনএফ নামে যত সন্ত্রাসী সংগঠন আছে; এদের সদস্যরা সবাই পাহাড়ি উপজাতিই। বাহিরের কেউ নেই। যার যার পাড়া তারা তারা ওইসব সংগঠনের হয়ে নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া যেদিন রাতে থান্দুই পাড়ায় পৌঁছাই, সেদিন পাড়ায় ঢুকার সময় কয়েকটা ছেলেকে হাতে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। এ সব অস্ত্র হাতে নিয়ে ঘোরা ওদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। ওই পাড়াটা ছিল বম উপজাতির পাড়া। কেএনএফ বলতে যেই সন্ত্রাসী বাহিনী আমরা চিনি ওরা এই বম উপজাতিদের দ্বারা গঠিত।

(২) ওরা কি আরাকান আর্মি ছিল?

না। কারণ আরাকান আর্মিদের হাতে মিলিটারিদের মতো হেভি উইপন থাকে। কাঁধে আর্মিদের ব্যাগ থাকে। মাথায় আর্মিদের হ্যাট বা ক্যাপ থাকে। পায়ে আর্মিদের জুতো থাকে। ওরা মুখ ঢেকে চলাফেরা করে না। আরাকান আর্মি ধরলে উলটোদিকে ফেরত পাঠিয়ে দিত। সাকা হাফংয়ের দিকে পাঠাত না। তাছাড়া যতটুকু জানি আরাকান আর্মি ট্যুরিস্টদের গায়ে হাত তোলে না। যোগী-জোতলং (উচ্চতায় যোগী ৪র্থ আর জোতলং ২য়) ট্রেইলে ২০/২৫ জন আরাকান আর্মির সামনে দিয়ে দলিয়ান পাড়ার দিকে হেঁটে গিয়েছি। ওরা কিছুই বলেনি।

(৩) বাম পাশের পাহাড়ের আলোগুলো ২৭ জন ট্যুরিস্ট গ্রুপের। তাহলে ডান পাশের পাহাড়ের উপরে ওই নীল আলোর সংকেতটা কিসের?

আমার ধারণা ওই নীল আলোটা দিয়ে সন্ত্রাসী অন্য দলটা ওদের এই পাশের সন্ত্রাসী দলকে (যে দলটা আমাদেরকে জিম্মি করেছিল) সতর্ক করেছে। কারণ, ওপর থেকে অনেক বড়ো একটা দল নেমে আসছিল (২৭ জনের ট্যুরিস্ট দলটা)। ওরা হয়তো এতক্ষণ আমাদের অপেক্ষায় ছিল যে ভোর হলে দু’দল মিলে আবার আক্রমণ করবে। মোট ৫০ জনের বিশাল ট্যুরিস্ট গ্রুপ দেখে আর সামনে আসেনি।

যা শিক্ষা পেলাম।

(১) উপজাতিদের আর কোনোদিন বিশ্বাস করব না। আমাদের ২৩ জনের দলে ৫ জন বন্ধু ছিল। ওনারা সেখানকার ১-১৫ বছর বয়সি কমপক্ষে ৪০ জন শিশু কিশোরদের জন্য অনেকগুলো নতুন টিশার্ট প্যান্ট কাঁধে করে কতগুলো পথ বেয়ে নিয়ে গিয়েছিল। নিজের জামাকাপড় নিয়েই তো হাঁটা যায় না। এর মধ্যে এতগুলো জামাকাপড় নিয়ে কতগুলো পাহাড় উঠতে নামতে হয়েছে ওনাদের। তো ওই সন্ত্রাসীগুলো কি এই খবরটা পায়নি? অবশ্যই পেয়েছে। ওদের ভেতরে যদি নূন্যতম মানবতা থাকত তাহলে আমাদেরকে এভাবে আঘাত করতে পারত না। কারণ, ওরা মানুষ হলে ভাবত, এই বাঙালিরা কত কষ্ট করে আমাদের বাচ্চাদের জন্য জামাকাপড় নিয়ে আসল, খাবার-দাবার ভাগ করে দিল। ওনাদেরকেই আবার কীভাবে আঘাত করি! ওরা আসলে মানুষের পর্যায়েই পরে না। (সবাই না; ওদের কিছু কিছু মানুষ খুব ভালো, একেবারে সহজ সরল, মাটির মানুষ। তবে বেশিরভাগই বিশ্বাসঘাতক, হিংস্র।)

(২) আগে ভাবতাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হয়তো উপজাতিদেরকে একটু বেশিই চাপে রাখে। শুধু আমিই না; আমরা বাঙালিরা সবাই এমনটাই ভাবি। আমাদের বাঙালিদের আসলে আলগা পিরিত বেশি। সেদিন বুঝলাম সেনাবাহিনী যা করে ভালোর জন্যই করে। সেনাবাহিনী না থাকলে আমরা থানচি বাজারেও যেতে পারতাম না হয়তো। আমরা ভ্রমণপিপাসু মানুষ, শান্তিপ্রিয় মানুষ। প্রকৃতিকে ভালোবাসি, তাই প্রকৃতির কোলে ছুটে যাই। আমরা বান্দরবানে কোনো ঝামেলা তৈরী করতে যাই না। ওদেরকে কাছে টেনে নেই। বুকে জড়িয়ে নেই। ওদের বাচ্চাদেরকে কতটা আপন করে নেই। ওদের মা-বোনকে নিজের মা-বোন মনে করি। ওদের বিপদ-আপদে যথাসাধ্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। অথচ ওরা আমাদেরকে শত্রুর চোখে দেখে। বাঙালিকে ওরা সহ্যই করতে পারে না। তাই সেনাবাহিনীকে তাদের কাজ তাদের মতো করতে দেজয়া উচিত। আমাদের ওসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করে। প্রতিটি সেনাসদস্য চৌকস এবং নিঃসন্দেহে খাঁটি দেশপ্রেমিক।

প্রতিজ্ঞা:

(১) ইনশাআল্লাহ আবার বান্দরবান যাবো। যাবই যাবো। এটা আমার দেশ। এটা স্বাধীন দেশ। আমার মাতৃভূমির যেথায় ইচ্ছে সেথায় যাব। কপালে মৃত্যু লেখা থাকলে মরব। তবুও কিছু উপজাতি সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহীদের ভয়ে চুপ করে বসে থাকব না। সেদিন আমাকে গলায় ড্যাগার ধরার পর ওদের একজন নিজের ড্যাগার দিয়ে নিজের বুকে হালকা বারি দিতে দিতে ইশারায় বোঝাতে চাচ্ছিল এটা আমাদের এলাকা। মানে আমরা যেন ওদের এলাকায় না যাই। আমার প্রথম থেকে ভিষণ রাগ উঠছিল ওদের কাজ দেখে। আমি “আর আসব না আর আসব না” বলিনি প্রথমে। তাই আমার গলায় দু’বার ড্যাগার চেপে ধরে। যেন ভয় পাই। কাপুরুষগুলোকে ভয় পাওয়ার কি আছে। আমাদের হাতেও অস্ত্র থাকলে বোঝা যেত কে কতটা সাহসি।

(২) সমুদ্র ভালোবাসি। পাহাড় ভালোবাসি। আমার জন্মভূমিকে ভালোবাসি। আমার দেশের মাটি বিশ্বাসঘাতক ও শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত রাখব ইনশাআল্লাহ।

সূত্রকারিম শাওন
আগের পোস্টউপজাতি ও আদিবাসী বিতর্ক: বাংলাদেশের বাস্তবতা এবং করণীয়।
পরের পোস্টঅনুপ কুমার চাকমাকে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন