রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ: বিরোধিতা থেকে সুবিধাভোগী হওয়া এক অধ্যায়। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি গোষ্ঠীর এমন দ্বৈত ভূমিকা প্রায়শই বিতর্ক সৃষ্টি করে।

0
ছবি: জেএসএস সহযোগী অঙ্গসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) মেডিকেল কলেজ এর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক কার্যালয় মানববন্ধন করে।

হান্নান সরকার

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলেও এর পথচলা সহজ ছিল না। এটি শুধু একটি মেডিকেল কলেজ নয়, বরং একটি উন্নয়ন উদ্যোগ যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ উদ্যোগ শুরু থেকেই স্থানীয় বিরোধী শক্তির সম্মুখীন হয়েছে।

২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের উদ্বোধন করেন। এ অঞ্চলে স্বাস্থ্য, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া এবং উন্নয়নের জোয়ার আনতে এটি ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। কিন্তু কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।

মেডিকেল কলেজটির নির্মাণ কাজ শুরু থেকে উদ্বোধন পর্যন্ত অনেকবার বাধা দেওয়া হয়েছে। কলেজ চালু উপলক্ষে একটি আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হয়। জেএসএস এবং তাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী শোভাযাত্রায় হামলার মাধ্যমে এ মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে। উদ্বোধনের দিন তারা কলেজটির পক্ষাবলম্বনকারী বাঙালিদের ওপর সরাসরি সশস্ত্র হামলা চালায়। এদিন উপজাতিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের পাশাপাশি দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা ব্যবহার করে। বাঙালি দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাঙালি পথচারীদের ওপর আক্রমণ করে। রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাঙালিদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এই সহিংসতা ব্যাপকতা ধারণ করে। নানিয়ারচর উপজেলার মনির হোসেন ছিলেন মেডিকেল কলেজের পক্ষে অন্যতম আন্দোলনকারী। বনরূপা বাজারে তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। তার ওপর এই আক্রমণ এতটাই মারাত্মক ছিল যে পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

মনির হোসেনের আত্মত্যাগ আজ প্রায় ভুলে যাওয়া ইতিহাস হয়ে গেছে। অথচ তার এই আত্মদান রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় উপজাতি নেতারা এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। তারা গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে এবং প্রধানমন্ত্রী বরাবর মেডিকেল কলেজ নির্মাণকাজ বন্ধ করার জন্য স্মারকলিপি প্রদান করে। তাদের দাবি ছিল, এই কলেজ প্রতিষ্ঠা তাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ওপর হুমকি সৃষ্টি করবে। রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও একইভাবে বাধার শিকার হয়েছিল।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, যারা একসময় এ মেডিকেল কলেজের নির্মাণকাজ থামানোর জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল, আজ তারাই এই কলেজের সুবিধা ভোগ করছে। মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় ৭৫ টি সিটের মধ্যে ট্রাইবাল কোটার আওতায় ২০টি আসন সংরক্ষিত। জনবল নিয়োগে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া এবং এই অঞ্চলে উন্নয়ন সাধিত করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত মোট ১২০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২০০ জন উপজাতি। এটি দেখায় যে এই উদ্যোগের প্রাথমিক উদ্দেশ্য যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।

অবাক করার বিষয় হলো, যারা একসময় কলেজের বিরোধিতা করেছিল, তারাই আজ এর সুবিধা ভোগ করছে। এর চেয়েও হতাশাজনক হলো, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে যেসব বাঙালির অবদান রয়েছে, তাদেরকে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়। মনির হোসেনের মতো মানুষ, যিনি নিজের জীবন দিয়ে কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন, তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

মনির হোসেন এক অবহেলিত নায়ক:
মনির হোসেনের আত্মত্যাগ ছিল রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় ধাপ। তার এই আত্মদানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি আবাসিক হল বা মেডিকেল কলেজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নাম তার নামে রাখা উচিত। এটি হবে তার অবদানের প্রতি একটি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন।

এছাড়াও, তার পরিবারের সদস্যদের জন্য চাকরি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত। এটি হবে প্রশাসনের মানবিক দায়িত্ব এবং তার আত্মত্যাগের প্রতি একটি ন্যায্য স্বীকৃতি।

উপজাতিদের সুবিধাভোগী হয়ে ওঠা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি গোষ্ঠীর এমন দ্বৈত ভূমিকা প্রায়শই বিতর্ক সৃষ্টি করে। রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে একই প্রবণতা দেখা যায়।

সড়ক যোগাযোগ, স্কুল, কলেজ এবং হাসপাতাল নির্মাণে প্রথমদিকে তারা বাধা দেয়। কিন্তু এসব সুবিধা চালু হওয়ার পর তারাই প্রথম এগিয়ে আসে এবং তা ভোগ করে। এই দ্বৈত অবস্থান শুধু উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে বিলম্বিত করে না, বরং সামগ্রিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজকে সত্যিকারের উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:

১. সকল জনগোষ্ঠীর সমান সুযোগ: বাঙালি এবং উপজাতি উভয়ের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
২. মনির হোসেনের স্মৃতি সংরক্ষণ: তার নামে একটি হল বা স্থাপনা নির্মাণ করা এবং তার পরিবারের কল্যাণ নিশ্চিত করা।
৩. উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার প্রসার: তাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা প্রকল্প চালু করতে হবে, যাতে তারা কলেজে আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে পারে।
৪. উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সবার অংশগ্রহণ: উন্নয়ন প্রকল্পে বিরোধিতা না করে সকল জনগোষ্ঠীকে এতে অংশগ্রহণ করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ একটি উন্নয়ন উদ্যোগ যা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছিল। এটি শুধু একটি মেডিকেল কলেজ নয়; এটি একটি প্রতীক যা প্রমাণ করে যে শিক্ষার মাধ্যমে উন্নয়ন সম্ভব।

কিন্তু এই প্রতীকের পেছনে যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, যেমন মনির হোসেন, তাদের অবদানকে কখনোই ভুলে গেলে চলবে না। প্রশাসনের উচিত এই ধরনের আত্মত্যাগকে সম্মান জানানো এবং উন্নয়ন প্রকল্পে সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা।

এ অঞ্চলের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। বিরোধিতা এবং সুবিধাভোগিতার দ্বৈত অবস্থান থেকে বের হয়ে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। তবেই রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ তার প্রতিষ্ঠার আসল উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে।

 

আগের পোস্টপার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন মেজর জেনারেল (অবঃ) অনুপ কুমার চাকমা। নিউজ ডেস্ক:
পরের পোস্টখাগড়াছড়িতে সেনা অভিযানে ইউপিডিএফ এর দুই একর গাঁজা খেত ধ্বংস।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন