বাঙালিদের ভোটার হওয়ার ভোগান্তি: উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাগজপত্র ও হয়রানির বাস্তবতা।

0

জিহান মোবারক
হিল নিউজ বিডি

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি জনগণের জন্য ভোটার হওয়া অনেক সময় একটি জটিল ও কষ্টকর প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত, সেখানে বসবাসকারী বাঙালিদের জন্য যেসব কাগজপত্রের প্রমাণ দিতে হয়, তা অনেক সময় পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়। তাছাড়া, এসব কাগজপত্র সংগ্রহের প্রক্রিয়াও অত্যন্ত কঠিন, সময়সাপেক্ষ এবং প্রায়ই হয়রানির শিকার হতে হয়। এই সমস্যাগুলি শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, বরং দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও প্রযোজ্য হলেও এখানে বিশেষভাবে এটি বেশি দেখা যায়।

ভোটার হওয়ার প্রক্রিয়া এবং প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র-

ভোটার হওয়ার জন্য সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুকে পূঁজি করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগণের জন্য যে অতিরিক্ত কাগজপত্রগুলো চাওয়া হয়, তা মূলত তাদের নাগরিক অধিকার আদায়ের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্বাচন অফিস কর্তৃক নতুন ভোটার হওয়ার জন্য যেসব কাগজপত্র সাধারণত চাওয়া হয়, বা হতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

১। অনলাইন জন্মসনদ (QR কোডযুক্ত অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ)

২। চেয়ারম্যান সনদ।

৩। মাতা, পিতা ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্বামী/স্ত্রীর আইডি কার্ডের ফটোকপি।

৪। হোল্ডিং টেক্স রশিদ/বিদ্যুৎ বিলের ফটোকপি।

৫। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ (যদি থাকে)।

৬। দলিলে ফটোকপি (পিতা/মাতার ও স্বামীর নামে হতে পারে)।

৭। কাবিননামা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।

৮। পাসপোর্ট/ভাইডিং লাইসেন্স এর ফটোকপি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)

৯। রক্ত পরীক্ষা সনদ।

১০। স্থায়ী বাসিন্দা সনদ (জেলা প্রশাসক/মং, চাকমা, বোমাং রাজা কর্তৃক)।

১১। খতিয়ানভুক্ত জমি না হলে ভূমিহীন সনদ (মৌজা প্রধান কর্তৃক প্রত্যয়ন)।

এখানে উল্লেখ যে, তারিখঃ ০৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, আগারগাঁও, ঢাকা, নির্বাচন সহায়তা-২ শাখা নং- ১৭,০০,০০০০,০২৬.৩২.০১২.২৩– বিষয়ঃ বিশেষ এলাকাসমূহে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম সহজীকরণের লক্ষ্যে করণীয় পরিপত্র-১, ৯টি শর্ত দিয়েছে ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে। এর মধ্যে ৩. বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র, ৪. বাবা-মায়ের AFIS প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যাচাই করা, ৫. পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে স্থায়ী বাসিন্দা সনদ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা (জেলা প্রশাসন বা রাজা বা হেডম্যান কর্তৃক প্রদত্ত), ৬. বাবা-দাদার জমির জমাবন্দি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা, ৭. ভূমিহীন সনদ, অনলাইন ভেরিফায়েবল ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানের রশিদ/পর্চা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা। শর্ত গুলো নিয়ে প্রবল আপত্তি দিয়েছে পার্বত্য বাঙালিরা।

ভোটার হওয়ার প্রক্রিয়ায় অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্রের প্রভাব-

প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার থাকা উচিত, এটি একটি মৌলিক অধিকার। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের জন্য যে অতিরিক্ত কাগজপত্রের প্রমাণ চাওয়া হয়, তা মূলত তাঁদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার একটি পদ্ধতি। এসব কাগজপত্র অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় এবং বিশেষ কিছু গোষ্ঠী বা জনগণের বিরুদ্ধে এটি লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।

এছাড়া, এসব কাগজপত্র সংগ্রহের প্রক্রিয়া এতটা জটিল যে, অনেক বাঙালির জন্য এটি একটি দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে ওঠে। জনসাধারণের মধ্যে অনেকেই বুঝতে পারেন না, কেন একজন নাগরিক হিসেবে ভোটার হওয়ার জন্য এতকিছু প্রমাণ দেওয়া দরকার।

বিশেষত, (৬) দলিলের ফটোকপি (পিতা/মাতার এবং স্বামীর নামে হতে পারে): ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রেই ভূমির মালিকানা বা বসবাসের প্রমাণ হিসেবে এটি চাওয়া হয়, যা অনেকের কাছে অপ্রয়োজনীয় এবং সময়সাপেক্ষ। একজন বাংলাদেশের নাগরিক ভোটার হওয়া তার নাগরিক অধিকার। এখানে তার জায়গা বা দলিল কেন বাধ্যগত হবে? যদি কারো জায়গা বা দলিল থাকা বাধ্যগত হয় তাহলে তার সে অধিকার মিটানোর দ্বায়িত্ব রাষ্ট্রের।

(১০) স্থায়ী বাসিন্দা সনদ (জেলা প্রশাসক/মং, চাকমা, বোমাং চীফ কর্তৃক বা কথিত রাজা): এই সনদটির প্রয়োজনীয়তা অনেক সময় স্পষ্ট হয় না এবং এটি এক ধরনের অতিরিক্ত ভারী প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা নিতে বৈষম্যের শিকার হতে হয় বাঙালিদের। মূলত এটি অসাংবিধানিক প্রথা। দেশের অন্য কোথাও এর প্রচলন নেই।

(১১) ভূমিহীন সনদ (মৌজা প্রধান কর্তৃক): এটি জমির মালিকানা না থাকার প্রমাণ হিসেবে চাওয়া হয়, তবে এটি পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি জনগণের জন্য একটি বাড়তি চ্যালেঞ্জ হয়। কারণ এখানে মৌজা প্রধান উপজাতি সম্প্রদায় থেকে। জাতিগত ভেদাভেদ থেকেই বৈষম্যের অংশ হিসেবে তিনি বাঙালি বা ভূমিহীনদের প্রত্যয়ন প্রদান করেন না।

তবে, জন্মনিবন্ধন সনদ, চেয়ারম্যান নাগরিক সনদ একজন ব্যক্তি ভোটার অধিকার লাভ করা যথার্থ বলে মনে করে আইন বিশেজ্ঞরা।

হয়রানি এবং অর্থ আদায়ের সুযোগ-

এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা শুধু একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জন্য এক ধরনের হয়রানির সুযোগ তৈরি করে। অনেক সময় এসব কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে জনগণকে বাধ্য করা হয় নানা ধরনের খরচ বহন করতে, যা আদতে নাগরিকদের কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের একটি পন্থা হয়ে দাঁড়ায়।

যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন, এখানে ভূমি সমস্যা, জাতিগত বৈষম্য, হেডম্যান কার্বারী, জনপ্রতিনিধি উপজাতি তাই অনেক সময় একে অপরকে সাহায্য করে না এবং সরকারি কর্মকর্তা, দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সহজে নিজেদের প্রভাব খাটাতে পারে, তাই এসব কাগজপত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এসব পরিস্থিতিতে, নাগরিকরা নিজেদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন।

বর্তমানে এই নিয়ে ইতোমধ্যে তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। খাগড়াছড়ির বাঙালি বাসিন্দা, জাবেদ পাটোয়ারী, কৌশিক রায়, বান্দরবানের এমদাদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, রাঙামাটি মনিরুল ইসলাম ও অভিলাষ বড়ুয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘হিল নিউজ বিডি’কে জানায়, “পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের ভোটারবিহীন করার মাধ্যমে নাগরিক অধিকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উচ্ছেদ করার নীল নকশা বাস্তবায়নে কাজ করছে উপজাতি সশস্ত্র সংগঠন এবং উপজাতি নেতৃত্বশ্রণী। বারবার পার্বত্য বাঙালিদের হয়রানি করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে আসছে। আমরা গত ২৩ জানুয়ারির পরিপত্র-১, বাতিল দাবি করছি। তাই তারই পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের ভোটার হওয়ার প্রক্রিয়াকে সহজ, স্বচ্ছ এবং নিঃশর্ত করতে হলে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এসব কাগজপত্রের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু বাদ দেওয়া উচিত এবং শুধুমাত্র নাগরিকতার প্রমাণ হিসেবে প্রয়োজনীয় তথ্যই সংগ্রহ করা উচিত।

এছাড়া, সরকারি কর্মকর্তাদের উচিত এই প্রক্রিয়াটি দ্রুত এবং মানুষের জন্য সহজ করে তোলা, যাতে কেউ কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন। সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের জন্য বিশেষ করে ভোটার হওয়ার সহজ ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে তারা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন।

এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি এবং জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্বশীলতা বাড়ানোর জন্য প্রচারণা চালানো। তাতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ তাদের ভোটাধিকার নিয়ে যথাযথভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।”

এটি স্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের ভোটার হওয়ার প্রক্রিয়ায় যে অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং নিয়মাবলী প্রবর্তন করা হয়েছে, তা এক ধরনের অতিরিক্ত বাধা সৃষ্টি করছে এবং জনগণকে হয়রানির শিকার করছে। সরকারের উচিত এই প্রক্রিয়াকে সহজ এবং জনগণের জন্য প্রাপ্য করে তোলা, যাতে সবাই তাদের নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারে।

আগের পোস্টপার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে কোরিয়ান রাষ্ট্রদূতের সাথে উপদেষ্টার বৈঠক।
পরের পোস্টসেনাবাহিনী নিয়ে কেএনএফের অপপ্রচার।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন