মোঃ তৈয়ব
রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডের পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স মাঠে শুরু হয়েছে চার দিনব্যাপী পার্বত্য মেলা ও তারুণ্যের উৎসব ২০২৫। এই উৎসব পার্বত্য অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং খাবারকে শহরে জনপদের সঙ্গে পরিচিত করানোর এক অনন্য উদ্যোগ। ২৯ জানুয়ারি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মেলা উদ্বোধন হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি থেকে এই মেলা চলবে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
মেলায় পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠী তাদের জীবনের এক টুকরো অংশ শহরের মানুষের সামনে তুলে ধরছে। ৮০টি স্টলে প্রদর্শিত হচ্ছে পাহাড়িদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক, খাবার, হস্তশিল্প এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী। তবে, মেলায় বাঙালিদের অংশগ্রহণ সীমিত থাকায় এটি একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে বলে সমালোচনার মুখে পড়েছে। স্টল বরাদ্দ নিয়ে উঠেছে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। মেলায় পাহাড়ি বাঙালি অনেকেই স্টল বরাদ্দ পায়নি।
মেলায় পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো অন্যতম আকর্ষণ হবে। বাঁশ দিয়ে রান্না করা বাম্বু চিকেন, শুঁটকি দিয়ে তৈরি নাপ্পি, সিধল শুঁটকির ভর্তা, পাহাড়ি পাজন, এবং বিভিন্ন ধরনের সেদ্ধ খাবার শহুরে মানুষদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে।
বাঁশের ভেতর রান্না করা বাম্বু চিকেন এক বিশেষ খাবার। মুরগির মাংস, কাঁচা মরিচ, আদা, রসুন, ধনেপাতা, হলুদসহ বিভিন্ন মসলা দিয়ে বাঁশের খোলসের ভেতর রান্না করা হবে। চুলার ধোঁয়া এবং বাঁশের স্বাদ মাংসের গন্ধে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। এছাড়া, বাঁশের ডাল দিয়ে রান্না করা শাকসবজি এবং মাছও মেলায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে।
পাহাড়ি ফলমূল, যেমন আনারস, পেঁপে, কলা এবং আমের সরাসরি পরিবেশনা মেলায় ভোজনরসিকদের আকর্ষণ করেছে। এ ছাড়া পাহাড়ি শাকসবজি দিয়ে তৈরি সেদ্ধ ভর্তাগুলো নতুন প্রজন্মের জন্য এক ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা এনে দিচ্ছে।
মেলার আরেকটি বিশেষ দিক হলো পাহাড়ি শিল্পীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা- সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু হয়েছে, রাত ১০টা পর্যন্ত চলবে নাচ-গান এবং নাটকের অনুষ্ঠান। এতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি শহরের মানুষদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। এটি প্রতিদিন চলবে। এই সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয়; এটি এক গভীর বার্তা বহন করে, যেখানে পাহাড়ি সংস্কৃতি ও জীবনধারার সৌন্দর্য প্রতিফলিত হয়।
বৈষম্যের সমালোচনা- যদিও মেলায় পাহাড়ি জীবনধারা উপস্থাপিত হয়েছে, তবে পার্বত্য বাঙালিদের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পার্বত্য বাঙালি নেতারা কেউ নিমন্ত্রণ পায়নি কিন্তু অতিথি মঞ্চে দেখা গেছে পাহাড়ি আধিপত্য। পার্বত্য বাঙালিদের জন্য নিমন্ত্রণ না থাকা এবং তাদের সংস্কৃতি উপস্থাপনে অনাগ্রহ পার্বত্য বাঙালি মানুষের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের উদ্যোগ জাতিগত বৈচিত্র্য এবং সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে আঘাত করতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। পাহাড়ে বাঙালিদের সাথে যে বৈষম্য চলে ঠিক একই বৈষম্য ঢাকায় পার্বত্য মেলায় বিদ্যমান, এমন মন্তব্যও শোনা যাচ্ছে। তবে সচেতন মহল বলছেন, বাঙালি জনগণকে আরও সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে মেলায়। এতে মেলার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পাবে।
মেলার পোশাক ও হস্তশিল্প- মেলায় পাহাড়ি বুনন শিল্প এবং পোশাক ছিল অন্যতম আকর্ষণ। নকশি করা পাহাড়ি পোশাক, নিজস্ব ডিজাইন করা শাড়ি, চাদর এবং টেক্সটাইল পণ্যগুলো ক্রেতাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হবে। হস্তশিল্পের বিভিন্ন উপকরণ, যেমন বাঁশ ও বেতের তৈরি সামগ্রী, ঘর সাজানোর পণ্য এবং অলংকার দর্শনার্থীদের মুগ্ধ ছড়াবে।
উৎসবের উদ্দেশ্য- পার্বত্য মেলা ও তারুণ্যের উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো সারাদেশের মানুষদের কাছে পাহাড়ের জীবনধারা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবার, পোশাক এবং হস্তশিল্প শহুরে মানুষের মাঝে নতুন আগ্রহ সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি, এই মেলা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তারা নিজেদের সংস্কৃতি এবং পণ্য বাজারজাত করতে পারবে।
উন্নত ভবিষ্যতের প্রত্যাশা- যদিও মেলার আয়োজন এবং পরিবেশনা প্রশংসিত হয়েছে, তবে এটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারত। জাতিগত বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে পার্বত্য বাঙালিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলে মেলার মূল উদ্দেশ্য আরও সফল হতে পারত।
পার্বত্য মেলা ও তারুণ্যের উৎসব ২০২৫ কেবল একটি উৎসব নয়; এটি পাহাড়ি জনপদ এবং শহুরে জনপদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির এক অসাধারণ প্রচেষ্টা। তবে এই সেতুবন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে প্রয়োজন উভয় পক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
লেখক: মোঃ তৈয়ব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র।