হান্নান সরকার
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের একটি বিশেষ অঞ্চল, যেখানে পাহাড়ি উপজাতি ও বাঙালি—এই দুই সম্প্রদায়ের বসবাস। দীর্ঘদিন ধরে এখানে বিশেষ আইন, বিধি এবং প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর রয়েছে, যা পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের মধ্যে একধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনের বৈষম্যের ফলে নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন উঠেছে।
এই পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সম্প্রতি ডায়ালগ ফর পিস চট্টগ্রাম হিলট্রাক্টস (ডিপিসি) নামের একটি পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনি অসামঞ্জস্য দূরীকরণের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছে। রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই স্মারকলিপি পাঠানো হয়।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এই স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, আইনজীবী, পেশাজীবী এবং সামাজিক কর্মীরা। এদের মধ্যে ছিলেন—
অধ্যাপক মো. হারুন অর রশীদ – সংগঠনের চেয়ারম্যান, সাংবাদিক এম. কামাল উদ্দিন – ভাইস-চেয়ারম্যান, এডভোকেট কামাল হোসেন সুজন – নির্বাহী পরিচালক, এডভোকেট আলাল উদ্দিন – পরিচালক (দপ্তর), এডভোকেট মুন্না সদ্দার – পরিচালক (অর্থ), এডভোকেট জিল্লুর রহমান – পরিচালক।
এডভোকেট আমিরুল ইসলাম – পরিচালক, এডভোকেট রাকিব হোসেন – সদস্য, আব্দুল্লাহ আল মামুন – শিক্ষানবীশ আইনজীবী, আইনুল হক – শিক্ষানবীশ আইনজীবী, নুর হোসেন – আইনজীবীর সহকারী
এছাড়া আরও অনেকে এই স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।
স্মারকলিপির মূল দাবি ও প্রস্তাবনা: স্মারকলিপিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামোর যে বৈষম্য রয়েছে তা দূর করার জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি উত্থাপন করা হয়েছে।
১. ‘উপজাতি’ ও ‘অ-উপজাতি’ শব্দ পরিবর্তন
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পার্বত্য অঞ্চলের সকল নাগরিককে সমানভাবে জাতীয় পরিচয়ে সংযুক্ত করতে হবে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘উপজাতি’ এবং ‘অ-উপজাতি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়, যা বিভেদ সৃষ্টি করে। সংগঠনটি এই শব্দ পরিবর্তন করে স্থায়ী বাসিন্দাদের জাতিগত পরিচয় ব্যবহারের দাবি জানিয়েছে।
২. জেলা পরিষদে সকল জনগোষ্ঠীর জন্য সমান অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব
বর্তমান আইন অনুযায়ী, পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত। এটি বৈষম্যমূলক হিসেবে উল্লেখ করে স্মারকলিপিতে দাবি করা হয়েছে—
জনসংখ্যার অনুপাতে সকল জনগোষ্ঠীর জন্য জেলা পরিষদে আসন বরাদ্দ করতে হবে।
চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান পদের জন্য উন্মুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে যে কেউ যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হতে পারেন।
৩. ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এটি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানার ওপর অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ বলে সংগঠনটি মনে করে। স্মারকলিপিতে এই অনুমোদন বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে, যাতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের ভূমির ওপর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
৪. আঞ্চলিক পরিষদ আইন বাতিলের দাবি
সংগঠনটি পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে বৈষম্যমূলক ও অগণতান্ত্রিক বলে অভিহিত করেছে এবং এটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
৫. সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ
স্মারকলিপিতে জোর দেওয়া হয়েছে যে, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী সকল নাগরিককে সমান অধিকার দিতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনি বৈষম্যের বাস্তব চিত্র:
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ আইন ও বিধির কারণে এই অঞ্চলের সাধারণ নাগরিকরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—
১. ভূমি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা
পার্বত্য অঞ্চলে ভূমির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইনগুলো জটিল ও দ্বন্দ্বপূর্ণ। অনেক সময় জনগণ জমির মালিকানা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হন।
২. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিনিধিত্ব সংকট
বাঙালি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠী অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনে সঠিক প্রতিনিধিত্ব পান না।
৩. বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সীমাবদ্ধতা
আইনি জটিলতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, যা উন্নয়নকে ব্যাহত করে।
সংকট নিরসনে করণীয়:
স্মারকলিপির মাধ্যমে উত্থাপিত দাবিগুলোর বাস্তবায়ন হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচার, সমানাধিকার ও সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে। সংকট নিরসনে কয়েকটি করণীয় হতে পারে—
১. অবস্থানভেদে সমান আইন প্রণয়ন – পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে সমান আইনি কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।
২. প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সৃষ্টি – সকল জনগোষ্ঠীকে স্থানীয় প্রশাসনে সমান সুযোগ দিতে হবে।
৩. ভূমি ব্যবস্থাপনায় সহজীকরণ – জমি ক্রয়-বিক্রয়ের উপর অযৌক্তিক বিধিনিষেধ তুলে দিতে হবে।
৪. উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি – ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে।
সরকারের ভূমিকা ও করণীয়:
সরকার চাইলে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনি ও প্রশাসনিক বৈষম্য দূর করতে পারে। সরকারকে অবশ্যই—
গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে সকল পক্ষের মতামত নিতে হবে।
সংবিধানের আলোকে নীতি নির্ধারণ করতে হবে।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনি বৈষম্য একটি বাস্তব সমস্যা, যা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। ডিপিসি সংগঠনের এই স্মারকলিপি সরকারের সামনে জনগণের দাবিগুলো উত্থাপন করেছে। এখন দেখার বিষয়, সরকার কত দ্রুত এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হলে একটি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে।