রানা নাভেদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম:
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আবারও বিতর্ক উঠেছে। এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তকে “আদিবাসী” শব্দের ব্যবহার নিয়ে এক পক্ষের আপত্তি ও অন্য পক্ষের সমর্থনের জেরে সংঘর্ষ হয়, যার পরিণতিতে গ্রেফতার হন শাহাদাত ফরাজি সাকিব।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মতিঝিল থানায় একটি মামলায় শাহাদাত ফরাজি সাকিবকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগটি ছিলো হামলা করার, যদিও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আসলে, তিনি এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তকে “আদিবাসী” শব্দ ব্যবহারের প্রতিবাদ ১৫ ফেব্রুয়ারি স্টুডেন্টস ফর সভারন্টির আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে যোগদান করেন।
ওইদিন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ অলিক মৃ এবং বাম ছাত্র ইউনিয়নের আরমানের নেতৃত্বে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে পাহাড়ি ও বাঙালি—উভয় পক্ষের মানুষ আহত হন। কিন্তু মামলা দায়ের করা হয় মূলত বাঙালিদের নামে, যার ফলে সাকিবকেও অন্যায়ভাবে আসামি করে গ্রেফতার করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাকিব নিয়ে পার্বত্য বাঙালি ও নেটিজেনরা বলছেন, তাকে শুধুমাত্র ভিন্নমত প্রকাশের জন্যই গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি কোনো সংঘর্ষে জড়িত ছিলেন না, বরং বিতর্কিত শব্দ ব্যবহারের বিরোধিতা করেছিলেন। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, মতপ্রকাশ কি অপরাধ?
বিশ্লেষকদের মতে, সাকিবের গ্রেফতার বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করার একটি প্রচেষ্টা হতে পারে। কেননা, এভাবে একজন নাগরিককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হলে ভবিষ্যতে অন্যরাও তাদের মতামত প্রকাশ করতে ভয় পাবেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শাহাদাত ফরাজি সাকিবের মুক্তির দাবিতে অনেকেই সরব হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সুপরিচিত ব্লগার ও লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য।
তিনি ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন—
> “শাহাদাত ফারাজি শাকিবকে আদিবাসী ইস্যুতে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অবিলম্বে শাকিবের মুক্তি দাবি করছি। আগে শাকিবকে ছাড়েন। আমি নিজে দায়িত্ব নিচ্ছি, আমি ওর জামিনদার হতে রাজি আছি। যত দ্রুত সম্ভব শাকিবকে জামিন দিন। সবাই আওয়াজ তুলুন— শাকিবের মুক্তি চাই।”
মো. তারেক রহমান, গণ অধিকার পরিষদের একাংশের নেতা ও জনপ্রিয় তরুণ রাজনীতিবিদ, ২২ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শাহাদাত ফরাজি সাকিবের আটকের প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, “নাগরিক কমিটি শুধু শাহাদাতকে বহিষ্কারই করেনি, বরং হুমকি দিয়ে আটক করিয়েছে। তার অপরাধ ছিল স্টুডেন্ট ফর সোভারেন্টিনের পক্ষে ফেসবুকে লেখা। পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির প্রতিবাদে NCB-এর সামনে স্টুডেন্ট ফর সোভারেন্টিনের কর্মসূচিতে সংঘর্ষ হলে কয়েকজন আহত হন।
নাগরিক কমিটির হুমকিতে স্টুডেন্ট ফর সোভারেন্টিনের ৪ কর্মীকে আটক করা হয়, আর শুধুমাত্র লেখালেখির কারণে শাহাদাতকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তারেক রহমান এটিকে সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে এই গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছেন এবং আটককৃতদের মুক্তি দাবি করেছেন।”
পার্বত্য ব্লগার, লেখকরাও সাকিব ইস্যুতে সবর। এবং স্থানীয় বাঙালিদের অনেকটা সাকিবের মুক্তির দাবি জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সবর ভূমিকা রাখছে।
সাকিবের গ্রেফতার নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মতপ্রকাশের অধিকারকে দমিয়ে রাখার একটি প্রয়াস। বিশেষ করে, এনসিটিবির বইয়ে “আদিবাসী” শব্দ বহাল রাখার পক্ষে ও বিপক্ষে বিতর্ক তুঙ্গে থাকায় এ ঘটনায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিক সমাজের একটি অংশ মনে করেন, ভিন্নমতকে দমন করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক।
মুক্তি কি মিলবে?
স্থানীয় বাঙালিরা অভিযোগ করেছেন, শাহাদাত ফরাজি সাকিব ইস্যুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের নীরবতা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নাগরিক পরিষদকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে, কারণ এখন পর্যন্ত তারা সাকিবের মুক্তির দাবিতে কোনো কর্মসূচি নেয়নি। অথচ সাকিব নাগরিক পরিষদের সহযোগী অঙ্গসংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এদিকে স্টুডেন্টস ফর সভারন্টির আটককৃত নেতাকর্মীদের বিষয়েও খবর রাখেনি সংগঠনটি!
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তার অনেক অবদান ছিল। অথাৎ জুলাই বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। অথচ জাতীয় নাগরিক কমিটি তাকে ধানমন্ডি থানার আহ্বায়ক পদ থেকে বহিষ্কার করেছে, যা নিয়েও বিতর্ক চলছে।
স্থানীয় বাঙালিদের দাবি, জাতীয় নাগরিক কমিটি বাম রাজনৈতিক দল ও উপজাতি সংগঠনের প্রভাবের ফলে ‘আদিবাসী’ শব্দের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং অন্যায়ভাবে সাকিবকে বহিষ্কার করেছে।
সাকিবের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন মহল সোচ্চার হচ্ছে, তবে সেটি কতটা কার্যকর হবে, তা এখনো বলা কঠিন। যদি এই প্রতিবাদ আরও বড় আকার নেয় এবং আইনি লড়াই চালানো হয়, তবে সাকিব দ্রুত মুক্তি পেতে পারেন। তবে আশার বাণী হলো আজ একই মামলার আসামী তিনজনের জামিন হয়েছে । পার্বত্য বাঙালিরা আশাবাদী সাকিব সহসাই ফিরবে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটা সুরক্ষিত, সাকিবের ঘটনা সেটিরই একটি পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন দেখার বিষয়, ন্যায়বিচার জয়ী হয় নাকি অন্যায়ভাবে হয়রানির শিকার হতে থাকেন নিরপরাধ মানুষ।