পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান—এই তিন জেলা বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি। এখানে বাঙালি জনগোষ্ঠীরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বসবাস করে, যারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সরকারি সুযোগ-সুবিধার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, মহাখালী, ঢাকা-১২১২ কর্তৃক ০২ মার্চ ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি বাঙালি নারীদের জন্য এক চরম বৈষম্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি স্মারক অনুযায়ী, পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের জন্য ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে তিন বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সে ভর্তি সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। এতে বিনামূল্যে ভর্তি সংক্রান্ত ওরিয়েন্টেশন, লজিস্টিক সহায়তা ও অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা হবে। তবে এই সুবিধা কেবল উপজাতি নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে, যা পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সুস্পষ্ট বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।
এই বিজ্ঞপ্তিটি স্বাক্ষর করেছেন মোঃ আনোয়ার হোছাইন আকন্দ, মুখ্যসচিব ও মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব), নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, মহাখালী, ঢাকা-১২১২।
বাংলাদেশ সরকার নারী শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের এই বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের অন্তর্ভুক্ত করে বাঙালি নারীদের বাদ দেওয়া ন্যায়সঙ্গত কি?
এই প্রশ্নটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি নারীরাও একই রকম বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করেন। তাদেরও রয়েছে আর্থিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতা, শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জ, এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাব। তাহলে কেন শুধুমাত্র এক বিশেষ জনগোষ্ঠীকে এই সুযোগ দেওয়া হবে এবং অন্যরা বঞ্চিত থাকবে?
বৈষম্যের বাস্তব চিত্র: সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে যে, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবানে প্রায় তিন শতাধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী শিক্ষার্থী মিডওয়াইফারি শিক্ষা মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। এই তালিকায় বাঙালি নারীদের কোনো স্থান নেই।
একটি গণতান্ত্রিক ও সাম্যের রাষ্ট্রে এমন পক্ষপাতদুষ্ট নীতি গ্রহণ করা আদৌ গ্রহণযোগ্য কি? বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
“রাষ্ট্র কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।”
এই সংবিধানিক নীতির পরিপন্থী হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি নারীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে, যা সুস্পষ্টভাবে সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।
বাঙালি নারীদের বঞ্চিত করার কারণ কী?
সরকারি প্রশাসনের দাবি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা শিক্ষায় পিছিয়ে রয়েছে, তাই তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দরকার। তবে বাস্তবতা হলো, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি নারীদের অবস্থাও ততটাই করুণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির ফলে বাঙালিদের জন্য সরকারি চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, এবং এখন শিক্ষা ক্ষেত্রেও একই বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে।
অনেকে বলছেন, এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও জাতিগত সমীকরণের একটি অংশ। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়নাধীন UNFPA-এর কারিগরি সহায়তায় “Strengthening the National Midwifery Programme (SNMP) through DGNM” প্রকল্প বিশেষত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে বসবাসরত বাঙালি নারীদের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি, যা চরম বৈষম্যের পরিচায়ক।
বাঙালি নারীদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে:
বাঙালি নারী শিক্ষার্থী হাবিবা জান্নাত বলেন, “সরকারের উচিত এই পক্ষপাতদুষ্ট নীতি পুনর্বিবেচনা করা। শিক্ষার অধিকার সকল নাগরিকের জন্য সমান হওয়া উচিত। মিডওয়াইফারি শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সুযোগ দেওয়া হলে, তা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াবে।”
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বাঙালিদের দাবি:
১. পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল নারীর জন্য সমান সুযোগ: বাঙালি ও উপজাতি নির্বিশেষে পার্বত্য অঞ্চলের সকল নারীর জন্য মিডওয়াইফারি কোর্সের সুযোগ উন্মুক্ত করতে হবে। ২. বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার: কেবলমাত্র এক জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করে অন্যদের বঞ্চিত করার নীতি বাতিল করতে হবে। ৩. সরকারি নীতি পুনর্বিবেচনা: পার্বত্য অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বৈষম্যের শিকার না হয়। ৪. সকল নারীর ক্ষমতায়ন: পার্বত্য অঞ্চলের সকল নারীকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সমান সুবিধা দিতে হবে, যাতে তারা জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই:
বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক সমাজ, যেখানে সকল জনগোষ্ঠীর সমান অধিকার থাকা উচিত। মিডওয়াইফারি শিক্ষার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র উপজাতি নারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ তৈরি করা হলে তা সমতার নীতির পরিপন্থী হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি নারীরাও এই সুযোগ পাওয়ার যোগ্য। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ আনোয়ার হোছাইন আকন্দ কর্তৃক ০২ মার্চ ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিটি সংশোধন করে সকল জনগোষ্ঠীর নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সরকারের উচিত ন্যায়বিচারের স্বার্থে সকল নারীকে সমান সুযোগ প্রদান করা এবং সাম্যের নীতিকে বাস্তবায়ন করা।