মুক্তমত | পানছড়ি খাগড়াছড়ি
পাহাড়ের বাতাসে আজ শুধুই আর্তনাদ, স্বজনহারা কান্না আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হলে সন্তান তার মায়ের হত্যার বিচার চাইতে পারে না? কতটা ভয়ভীতির ছায়া বিস্তার করলে মানুষ রক্তের দাগ শুকানোর আগেই নীরবতার কারাগারে আবদ্ধ হয়? পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন আইনের শাসন নেই, আছে জেএসএস ইউপিডিএফ এর বন্দুকের শাসন, হত্যা, হুমকি আর বিচারহীনতার এক ভয়ংকর সংস্কৃতি।
গতকাল সকালে পানছড়ির হাতিমারা গ্রামে তিন বছরের শিশু বন্ধনা চাকমার সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারালো তার মা রূপসী চাকমা (২৫)। জেএসএস ও ইউপিডিএফের অস্ত্রধারীরা যখন শক্তি প্রদর্শনে এই হত্যাযজ্ঞ চালালো, তখন তার স্বামী হেমন্ত চাকমা হয়তো বুঝতেও পারেনি যে তার সংসারের আশ্রয় ছিনিয়ে নেওয়া হবে এত সহজে।
এই প্রথম নয়—পাহাড়ে এ যেন এক নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৩ জানুয়ারি বান্দরবানে উমেপ্রু মারমা নিহত হলো জেএসএসের সন্ত্রাসী গুলিতে। ২০২৪ এর ১২ ফেব্রুয়ারি সাজেকে আঞ্চলিক দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে আহত সাত বছরের রোমিও ত্রিপুরা তিন মাস পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেল। এমনকি ২০০৪ সালে লোগাংয়ে ১৩ বছরের পুতুলী চাকমার জীবন কেড়ে নেওয়া হয় ইউপিডিএফের বুলেটে। এমন অনেক হত্যাকাণ্ড আছে।
কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডগুলোর কোনো বিচার হলো কি? একটিও থানায় মামলা পর্যন্ত গড়াল না! রূপসী চাকমার মৃত্যুর পর পানছড়ি থানার ওসি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন—কেউ অভিযোগ করেনি। স্বজনেরা সাহস পেল না, কারণ তারা জানে, বিচার চাইতে গেলেই পরিণতি হবে আরও ভয়ানক।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন আর রাষ্ট্রের শাসন নেই, আছে সন্ত্রাসীদের অলিখিত শাসন। এখানে মা-বাবার সামনে সন্তান খুন হলে তারা নিরব থাকে, সন্তানদের সামনে মা-বাবা খুন হলেও কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। কারণ, পাহাড়ের মানুষ জানে—বিচার চাইতে গেলে পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সেগুলো নিঃশব্দে ধামাচাপা দিয়েছে। এসব নৃশংস হত্যার ঘটনা কখনো প্রকাশ্যে আসে না, আর ভয়ের কারণেই কেউ তা জানাতেও সাহস করে না।
সুশীল সমাজ যখন সন্ত্রাসীদের সুরে বলে পাহাড়ে সেনাশাসন চলছে, তখন প্রশ্ন ওঠে—যদি সত্যিই সেনাশাসন চলতো, তবে কি একটি হত্যাকাণ্ডের পর থানায় মামলা পর্যন্ত হতো না? তাহলে কেন পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষগুলো আজ নিরাপত্তাহীনতার এমন এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত যেখানে মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু বিচার অনিশ্চিত? তাদের অসংখ্য অভিযোগের পরও বলতে হয়—পাহাড়ে সেনাবাহিনী আছে বলেই হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা এখনো কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। যদি সেনাবাহিনী না থাকত, তাহলে এই সংখ্যা সীমা ছাড়িয়ে ভয়াবহ রূপ নিত।
আজকের পাহাড়ে কেউ জানে না, কে কখন রূপসী চাকমার মতো অনন্ত নীরবতার শিকার হবে। হয়তো কাল, হয়তো পরশু, হয়তো এক শিশু তার মায়ের রক্তাক্ত দেহের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবে—আমার মায়ের কী অপরাধ ছিল? কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ দেবে না, কারণ এই পাহাড়ে উত্তর দেওয়ার মতো কেউ বেঁচে থাকে না।
আজ রূপসী চাকমার তিন বছরের কন্যা নিশ্চুপ বসে আছে, কিছুই বোঝার বয়স হয়নি তার। কিন্তু যখন সে বড় হবে, তখন জানবে—তার মায়ের হত্যার বিচার চেয়েও সে পায়নি। তখন এই পাহাড়ে ন্যায়বিচারের বুনিয়াদ আরও দুর্বল হবে, আরও গভীর হবে অরাজকতার শেকড়।
একবার ভাবুন, কতটুকু ভয় আর কতটা জিম্মি হলে একজন মা খুন হওয়ার পর তার স্বজনেরা থানায় পর্যন্ত যেতে পারে না? কতটা শাসনহীনতা থাকলে, কতটা বেনিয়ম চললে পাহাড়ের মানুষ এভাবে নিঃশব্দ মৃত্যুর মিছিল বানিয়ে বেঁচে থাকে?
এই নৈরাজ্য, এই বিচারহীনতা, এই রক্তাক্ত পাহাড় কি কখনো ন্যায়বিচার পাবে? নাকি পাহাড়ের প্রতিটি পরিবার একদিন রূপসী চাকমার পরিবারের মতো অনন্ত নীরবতার শিকার হবে?