আল শাহরিয়ার রোকন
শ্রমবাজারে কথিত আদিবাসী নারী, মিথ্যার বিপরীতে সত্যের অবস্থান।
বাংলাদেশে নারী শ্রমবাজার নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে, কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মহল প্রকৃত সত্য আড়াল করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ০৮ মার্চ ২০২৫ ইলিরা দেওয়ানের প্রকাশিত লেখাটি তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তার লেখায় কথিত আদিবাসী নারীদের নিয়ে যে অভিযোগ, যে তথ্য, যে পরিসংখ্যান হাজির করা হয়েছে, তা মূলত বিকৃত, অতিরঞ্জিত ও বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। মূলত, পাহাড়ে উপজাতি নারীদের অধিকার, কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো, যারা নারীদের একদিকে ব্যবহার করছে ঢাল হিসেবে, অন্যদিকে তাদের কণ্ঠরোধ করছে নিপীড়ন ও হুমকির মাধ্যমে।
আদিবাসী না উপজাতি?
ইলিরা দেওয়ানের লেখার একটি বড় সমস্যা হলো ‘আদিবাসী’ শব্দের অপব্যবহার। সচেতন মহল মাত্রই জানে যে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের ব্যাপক অন্তর্নিহিত তাৎপর্য রয়েছে। বস্তুত নৃতাত্ত্বিক গত দিক থেকে এদেশে কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাসের ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। উপরন্তু বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এদেশে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার ও স্বীকৃতি এদেশের সর্বভৌমত্বের জন্য পরোক্ষ হুমকি হিসেবে বিবেচ্য। অথচ কিছু ব্যক্তিস্বার্থবাদী উপজাতি ব্যক্তি বর্গ, বামপন্থী ও এনজিও-নির্ভর মহল এই শব্দকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরে। যেকারণে বাংলাদেশ সরকার এদেশের সংবিধান এবং পার্বত্য চুক্তির জেলা পরিষদ আইন খণ্ড (খ) তে এদেশের সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত অবাঙালি অধিবাসীদের ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি দূর করেছে। সরকার বিভিন্ন সময় পরিপত্র জারি করে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহারও নিষিদ্ধ করেছে। ইলিরা দেওয়ান বর্তমানে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিশনে দায়িত্বরত থাকার পরও কিভাবে রাষ্ট্রের এধরণের একটি গুরুত্ত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত বিরোধী কাজে সম্প্রীক্ত হন তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। এটি নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থের বিপরীতে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের একক স্বার্থ সংরক্ষণের একটি অপপ্রয়াস হিসেবে প্রতিয়মান যার সদুত্তর ইলিরা দেওয়ানের কাছে কাম্য।
উপজাতি নারীদের অবস্থান, সত্য উদঘাটন—
ইলিরা দেওয়ানের মতো তথাকথিত নারী অধিকার কর্মী ও মানবাধিকারকর্মীরা উপজাতি নারীদের অবস্থা নিয়ে একতরফা অভিযোগ তুললেও, তারা কখনো পাহাড়ের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকার কথা বলেন না। বাস্তবে পাহাড়ে উপজাতি নারীদের অধিকার রক্ষার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউপিডিএফ (প্রসীত), জেএসএস সন্তু, কেএনএফ ও এমএন লারমা গ্রুপের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো।
এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কীভাবে উপজাতি নারীদের নিয়ন্ত্রণ করে?
(১) শিক্ষার বাধা: পাহাড়ে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সীমিত। উপজাতি নারীদের সুশিক্ষা গ্রহণের প্রধান বাধা এই আঞ্চলিক সন্ত্রাসীরা, যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে নারী শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে।
(২) চাকরি ও অর্থনৈতিক সুযোগ ধ্বংস: উন্নয়ন প্রকল্পে উপজাতি নারীদের অংশগ্রহণ থাকলেও, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর চাঁদাবাজি ও হামলার কারণে অনেক প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। ফলে উপজাতি নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়।
(৩) নিরাপত্তাহীনতা ও নিপীড়ন: পাহাড়ে উপজাতি নারীরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হয় নিজ সম্প্রদায়ের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে। যৌন সহিংসতা, অপহরণ, ধর্ষণ, এমনকি হত্যা পর্যন্ত ঘটছে প্রতিনিয়ত যার জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছে দুদিন আগে পানছড়িতে ঘটে যাওয়া বন্দনা মা হত্যার ঘটনায়।
ইলিরা দেওয়ান: নারীর পক্ষে নাকি সন্ত্রাসের মুখপাত্র?
ইলিরা দেওয়ান নিজেই একসময় হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন, যা আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী নারী সংগঠন হিসেবে কাজ করে। তখন তিনি কখনো পাহাড়ে নারীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। তিনি যখন এই সন্ত্রাসী সংগঠনের ছত্রছায়ায় ছিলেন, তখন কীভাবে পাহাড়ি নারীদের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখলেন? তিনি তখন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো বিবৃতি দেননি, বরং তাদের নীরব সমর্থক ছিলেন।
এখন তিনি কীভাবে মানবাধিকার কর্মী হলেন? কীভাবে তিনি স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য হলেন? এটা আমাদের জন্য বিস্ময়কর ও দুঃখজনক। একজন সন্ত্রাসী সংগঠনের সহযোগী কীভাবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে পারেন? তার অতীত কার্যক্রম কি পর্যালোচনা করা হয়েছে?
শ্রমবাজার ও উপজাতি নারীদের বাস্তবতা—
উপজাতি নারীদের শ্রমবাজারে অবদান কম নয়, তবে ইলিরা দেওয়ান তাদের প্রকৃত অবস্থা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। বাস্তবতার কিছুটা নিম্নে তুলে ধরা হলো :
(১) উপজাতি নারীরা শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারছে কি না?
অনেক উপজাতি নারী সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।
সেনাবাহিনীতে, পুলিশ বাহিনীতে, প্রশাসনে, শিক্ষকতা পেশায় উপজাতি নারীরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন।
ক্ষুদ্র ব্যবসা ও হস্তশিল্পেও তাদের সফলতা রয়েছে।
(২) উপজাতি নারীরা বাধার মুখে পড়ছে কার কারণে?
ইউপিডিএফ-জেএসএস সন্ত্রাসীরা তাদের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করছে।
উন্নয়নমূলক কাজ ব্যাহত করতে এরা ভয়ভীতি ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছে।
পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বাধার কারণে উপজাতি নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
(৩) ইউপিডিএফ ও জেএসএসের বিরুদ্ধে উপজাতি নারীরা প্রতিবাদ করতে পারছে না কেন?
এই সন্ত্রাসীরা নারীদের মুখ বন্ধ রাখতে ভয়ভীতি দেখায়।
যারা প্রতিবাদ করেন, তারা গুম, অপহরণ বা হত্যার শিকার হন।
নিজেদের স্বার্থে এই তথাকথিত মানবাধিকার কর্মীরা আসল সত্য তুলে ধরেন না।
উপজাতি নারীদের উন্নয়নের জন্য কী করা উচিত?
(১) সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে হবে: পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ বন্ধ করতে হবে।
(২) শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে: উপজাতি নারীদের উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত শিক্ষার জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে হবে।
(৩) নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে হবে: সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উপজাতি নারীদের জন্য বিশেষ সহায়তা প্যাকেজ চালু করতে হবে।
(৪) আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে: পাহাড়ি নারীদের ওপর যারা নিপীড়ন চালায়, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান ও তার মতো তথাকথিত মানবাধিকার কর্মীদের আসল উদ্দেশ্য সমতল বা পাহাড়ি জনগণের উন্নয়ন নয়, বরং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং সমতলের মোড়লদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। তারা উপজাতি নারীদের প্রকৃত সমস্যার কথা না বলে সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে।
এই মুহূর্তে আমাদের সকলের উচিত—উপজাতি নারীদের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য কাজ করা, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সমতল ও পাহাড়ে বৈষম্য দুর করা এবং সন্ত্রাসীদের সমূলে নির্মূল করা। কারণ নারীর অধিকার তখনই সুরক্ষিত হবে, যখন বৈষম্য ও সন্ত্রাসমুক্ত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।