আধিপত্য বিস্তারের নামে নরকযন্ত্রণা: ভাই নিহত, নিরপরাধ বোন গুলিবিদ্ধ।

0

নিজস্ব প্রতিবেদক খাগড়াছড়ি | হিলনিউজবিডি  

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার তাইন্দং ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড, হেডম্যান পাড়া। ভোরের আলো ফোটার আগেই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের একদল ছায়ার মতো ভেসে এলো, অস্ত্রের নিশানা তাক করল প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ সদস্য সুবি ত্রিপুরার দিকে। মুহূর্তেই গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্রের তীব্র আওয়াজ, আর রক্তে লুটিয়ে পড়ল সুবি ত্রিপুরা (৩৫)। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণেই মৃত্যু হলো তার। কিন্তু সেই মৃত্যুর ছায়া শুধুই কি তার ওপর নেমে এল? না, সুবির বোন, নিরপরাধ তারাপতি ত্রিপুরা (২০)-ও সেই দুঃস্বপ্নের শিকার হলো। তার কপালে গুলি লাগল—সে এখন আহত! তবে এই যাত্রায় সে বেচে গেছে।

নিষ্পাপ বাচ্চা মায়ের সঙ্গে শুয়ে আছে, সে জানে না তার মা গুলিবিদ্ধ

এটা কি ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা? পাহাড়ের বুকে রক্তের ইতিহাস বলে—না, মোটেও না। মাত্র ১৬ দিন আগে পানছড়ির ধুধুকছড়ায় বন্দুকের নলে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল এক সাধারণ গৃহবধূ নারী, রূপসী চাকমা। মাত্র তিন বছরের শিশু বন্দনা চাকমা এখনো জানে না, তার মা কেন ফিরে আসবে না! ২০২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সাজেকে সাত বছরের রোমিও ত্রিপুরার ছোট্ট জীবনও কেড়ে নিয়েছিল এই দুই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর গুলির লড়াই। ২০০৪ সালে লোগাংয়ে ইউপিডিএফের বুলেটে ঝরে যায় মাত্র ১৩ বছরের কিশোরী পুতুলী চাকমার জীবন!

গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর  সুবি ত্রিপুরার লাশের মুখে পা দিয়ে উল্লাস করছে জেএসএস সন্তুর সশস্ত্র সদস্যরা

এমনকি চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে উমেপ্রু মারমা নামে এক নিরীহ ব্যক্তিকেও হত্যা করেছিল জেএসএসের সন্ত্রাসীরা। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, উমেপ্রু কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, বরং সাধারণ জীবনের স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু পাহাড়ে সাধারণ থাকা মানেই যেন মৃত্যু অনিবার্য!

স্থানীয়দের ভাষ্য, আজ বুধবার (১৯ মার্চ ২০২৫) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে জেএসএস (সন্তু গ্রুপ)-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা শক্তি ত্রিপুরা ও কম্বল ত্রিপুরার নেতৃত্বে অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল পানছড়ির রূপসেন পাড়ায়। গভীর রাতে নো ম্যানস ল্যান্ড হয়ে অস্ত্রধারীরা ঢুকে পড়ে তাইন্দংয়ে। তারপর ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই রক্তের হোলি খেলা শুরু!

সাধারণ মানুষের চোখে এটি হয়তো আঞ্চলিক দুই গ্রুপের মধ্যকার সংঘর্ষ, কিন্তু অভ্যন্তরীণ তথ্য বলছে, এটি শুধুই প্রতিহিংসা নয়—এটি অস্ত্রের রোড দখলের খেলা। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর পানছড়ি ও মাটিরাঙার নিয়ন্ত্রণ ইউপিডিএফের হাতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে জেএসএস (সন্তু গ্রুপ) আবারো সেই নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভারত সীমান্তবর্তী পানছড়ির রুটটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি হলো অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার প্রধান রুট, যার দখল নিতে মরিয়া দুই বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আর এই সংঘাতের বলি হচ্ছে সাধারণ পাহাড়িরা।

মাটিরাঙা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জানিয়েছেন, “আমরা খবর পেয়েছি। ঘটনাস্থলে আমাদের টিম যাচ্ছে। বিস্তারিত ঘটনারস্থলে যাওয়ার পর জানা যাবে।”

এই পরিস্থিতি পাহাড়ের বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। যেখানে একের পর এক মানুষ নিহত হচ্ছে, সেখানে প্রশাসনের ভূমিকা কতটুকু কার্যকর?

পাহাড়ের এই রক্তাক্ত খেলায় বাংলাদেশ সরকার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন—”বর্তমানে ইউপিডিএফের উপর জেএসএস যে আক্রমণ পরিচালনা করছে, তা তাদের সুসংগঠিত সামরিক শক্তির ইঙ্গিত দেয়। ইউপিডিএফকে তাদের পূর্ববর্তী এলাকা থেকে সরিয়ে দিতে পারলে পাহাড়ে জেএসএসের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।”

এদিকে, স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, “আমরা কারো দখল চাই না, আমরা শান্তি চাই। ইউপিডিএফ জেএসএস মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ” কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই শান্তি কোথায়? অস্ত্রের রাজনীতিতে যখন সাধারণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়, তখন কি কেউ দায় নেবে? নাকি এভাবেই পাহাড় রক্তাক্ত হতে থাকবে?

 

আগের পোস্টখ্রিষ্টিয়ান আউট রিচ সেন্টারে উপজাতি কিশোরীর রহস্যজনক মৃত্যু: আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত হত্যা?
পরের পোস্টবান্দরবানে সেনা চেকপোস্টে খরাজ মুখার্জির সঙ্গে যা ঘটেছিল।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন