পার্বত্য রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার কলমপতিতে সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যার প্রকৃত তথ্য বিকৃত করে একপাক্ষিক ও মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আজ ২৫ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) হিল উইমেন্স ফেডারেশন পাহাড়িসহ সংগঠনগুলো তথাকথিত ‘কলমপতি গণহত্যা’ দিবস পালন করেছে, যেখানে সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
তবে প্রকৃতপক্ষে ১৯৮০ সনের ২৪ মার্চ কাউখালী উপজেলার কয়েকটি বাঙালি গ্রামে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে হতাহত ও অগ্নিসংযোগে ক্ষয়ক্ষতি হয়। যা নিয়ে পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে শান্তি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এই ঘটনার ঠিক একদিন পর ২৫ মার্চ সাপ্তাহিক কাউখালী হাটবাজারের দিন পোয়াপাড়া স্কুলে শান্তি সমাবেশের ডাক দেয় তৎকালীন ঘাগড়া জোনের সিও লে. কর্ণেল খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে কাউখালী ক্যাম্প। সকালে শান্তি সমাবেশে স্থানীয় পাহাড়ি সম্প্রদায়ের হেডম্যান, কার্বারী, মান্যগণ্য ব্যক্তি এবং বাঙালি নেতারা অংশ নেন। এসময় অতর্কিতভাবে শান্তিবাহিনী নামক জেএসএস-এর সশস্ত্র শাখার মেজর মলয় প্রকাশ রাঙামাটি জেলার সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদারের নেতৃত্বে বাঙালিদের পাহাড় থেকে নিধনের অংশ হিসেবে পোয়াপাড়া, বেতছড়ি, রাঙীপাড়া, কচুখালীসহ একাধিক বাঙালি গ্রামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। নিরস্ত্র বাঙালি নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ১৫০০-এর অধিক নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। নেতৃত্বহীন বাঙালিরা এর প্রকৃত পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করেনি। এই নিয়ে আছে বিভ্রান্তি, কারো ধারণা নিহতের সংখ্যা ৪৫০ থেকে ৭৫০ এর মধ্যে। তবে বেশিভাগ বলছে হতাহতের ঘটনা ১৫০০ এর কাছাকাছি হবে।
এই গণহত্যার প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দিতে তখনকার সময়ে শান্তিবাহিনী নিজেদের স্বজাতি পাহাড়িদের গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে এবং সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের ওপর দোষ চাপায়। ঢাকায় বামপন্থী নেতাদের দিয়ে তদন্তের নামে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, যা পরবর্তীতে জেএসএস এবং ইউপিডিএফ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
অপরদিকে, স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ সারোয়ার হোসেন অপূর্ব জানান, জাতীয় রাজনৈতিক দলের অনাগ্রহ ও বাঙালি নেতৃত্বের অভাবের কারণে বাঙালিরা আজও ‘কলমপতি বাঙালি গণহত্যা দিবস’ আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করতে পারেনি। যার ফলে পাহাড়ের বাঙালিরা নিজেদের ইতিহাস ভুলতে বসেছে, আর নতুন প্রজন্ম শান্তিবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অনবহিত থেকে যাচ্ছে।
আজকে ২৫ মার্চ রাঙামাটি সদরের রাঙাপানিতে তথাকথিত স্মরণ সভায় প্রধান আলোচক জেএসএস সহযোগী অঙ্গসংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদদের (পিসিপি) কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক জিকো চাকমা দাবি করেন যে, ‘জুম্ম জনগণকে জাতিগত নির্মূলের জন্য পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছিল।’
অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির সভাপতি রিতেশ চাকমা অভিযোগ করেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগোষ্ঠীগুলোকে পরিকল্পিতভাবে নিঃশেষ করতে চায়।’
আলোচক আবৃত্তি দেওয়ান দাবি করেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র গণহত্যার হোতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে এবং পাহাড়িদের ন্যায্য অধিকার রোধ করছে।’
একই দাবিতে স্মরণ সভা করেছে ইউপিডিএফ সহযোগী অঙ্গসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন। কলমপতি ইউনিয়নে এই স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। হিমেল চাকমার সভাপতিত্বে ও সোনালিকা চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন সোহেল চাকমা, শিখা চাকমা, সুইহ্লামং মার্মা। এতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর প্রতিনিধি তুজিম চাকমা।
পাহাড়ি সংগঠনগুলোর এসব একতরফা বক্তব্য এবং ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাঙালিরা। তাদের মতে, শান্তিবাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার তথ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরা জরুরি।
বাঙালিরা আজও পাহাড়ে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছে। কলমপতি গণহত্যার প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণ, দোষীদের বিচারের আওতায় আনা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চ ‘কলমপতি বাঙালি গণহত্যা দিবস’ পালনের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।