গত ৮ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে বান্দরবানের বেথেল পাড়ায় সেনাবাহিনীর একটি অভিযানকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ইয়েন ইয়েন’ নামক একজন নারীর পক্ষ থেকে একটি বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং চরম পক্ষপাতদুষ্ট পোস্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয়। Yan Yan নামক নিজের ফেসবুক আইডি থেকে পোস্টটিতে বম জনগোষ্ঠীর নারীদের ‘নির্বিচারে’ আটকের অভিযোগ তুলে সামগ্রিকভাবে সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালানো হয়। অথচ, পোস্টদাতার অতীত কার্যক্রম, পারিবারিক পরিচয় এবং পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়—এই পোস্টটি কোনো নিরপেক্ষ মানবাধিকার চেতনা থেকে নয়, বরং একটি সুস্পষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে তৈরি।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতে রুমা এবং থানচি এলাকায় Kuki Chin National Front (KNF) নামক সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা স্থানীয় সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ভয়াবহ ডাকাতি চালায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে ১৪টি অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। সরকারি অস্ত্র লুট, ব্যাংক ডাকাতি এবং রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়। এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের ধরতে গিয়ে প্রশাসন এলাকাভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে। বম অধ্যুষিত বেথেল পাড়ায় KNF সংশ্লিষ্টতা থাকার সন্দেহে অভিযান চালানো হয়।
তাহলে প্রশ্ন হলো—প্রশাসন কি হঠাৎ করে নিছক ‘বম’ হওয়ায় গ্রাম ঘিরে ফেলেছে? নিশ্চয়ই না। গোয়েন্দা তথ্য, অভিযুক্তদের গতিবিধি এবং আগের অপরাধের ভিত্তিতেই এই অভিযান।
যেসব বম নারী বর্তমানে আটক, তাদের বিরুদ্ধেও KNF এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট বা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় মামলা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট অভিযোগ এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া কাউকে মামলা দেওয়া বা আটকের সুযোগ নেই।
এখানে প্রশ্ন আসে—যদি এদের বিরুদ্ধে প্রমাণ না থাকে, তাহলে আদালত জামিন নামঞ্জুর করলো কেন? আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে, সেখানে ইয়েন ইয়েনের আবেগ-ভিত্তিক বক্তব্য নয়, বরং সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই বিচার হয়।
চাকমা কথিত রাজা দেবাশীষ রায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়েন ইয়েন একজন বার্মিজ রাখাইন নারী। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক-রাজনৈতিক রীতি ভেঙে একজন বহিরাগত হিসেবে রাজার ঘরে প্রবেশ করেন। তাঁর প্রতি চাকমা সমাজের একাংশের আস্থা নেই, এমনকি দেবাশীষ রায়ের প্রথম স্ত্রী তাতু রায়ের সন্তানরাও তাকে মেনে নেয়নি। নিজেকে পাহাড়ি সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে প্রমাণ করতে ইয়েন ইয়েন বাঙালি, সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রবিরোধী ইস্যুগুলো বেছে নেন। অথচ প্রকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় তাঁর নীরবতা চোখে পড়ার মতো।
তাঁর পোস্টে আমরা দেখি, বম নারী ও শিশুদের প্রতি মায়াকান্না। অথচ, একই পাহাড়ে— খাগড়াছড়ির ধুধুকছড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে রূপসী চাকমা নামের এক নারী জেএসএস ও ইউপিডিএফ মধ্যকার সশস্ত্র লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন; রাঙামাটি সাজেকে সাত বছরের রোমিও ত্রিপুরা সন্ত্রাসী গুলিতে মারা গেছে; বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে নিরীহ উমেপ্রু মারমাকে হত্যা করা হয়েছে জেএসএস সন্ত্রাসীদের গুলিতে।
এই ঘটনাগুলোর কোনোটিতেই ইয়েন ইয়েনের পোস্ট, প্রতিবাদ, ভিজিট বা সোশ্যাল মিডিয়া স্টেটমেন্ট দেখা যায়নি। তাহলে তার মানবাধিকারের সংজ্ঞা কী? কেবল KNF সংশ্লিষ্ট অভিযানে আটক হওয়া ব্যক্তির পক্ষেই কেন সরব তিনি?
ইয়েন ইয়েন দাবি করেন—”চার ঘন্টা নারী, শিশু, বৃদ্ধদের রোদের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়েছে।” বাস্তবতার বিচারে এই তথ্য অতিরঞ্জিত। সেনাবাহিনীর যেকোনো অভিযান আন্তর্জাতিক মান ও মানবিক আচরণের ভিত্তিতে হয়।
তিনি আরও লেখেন—”মাত্র দেড় মাস বয়সী শিশুকে জেলে রাখা হয়েছে।” এখানে প্রশ্ন হলো—জেল কর্তৃপক্ষ কীভাবে শিশুকে ‘আসামী’ হিসেবে বিবেচনা করবে? আসলে, শিশুরা তাদের মায়ের সঙ্গে আছে, কারণ তাদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয় মা-সন্তানের সংযুক্ত অবস্থানেই। এই বিষয়টিকে বিকৃতভাবে তুলে ধরা চরম অমানবিক প্রচার।
২০১৮ সালে বিলাইছড়ির মারমা দুই বোনকে সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের অভিযোগে ইয়েন ইয়েন সরব হন। পরে মেডিক্যাল রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে যায়—তাদের উপর কোনো ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হলো—অভিযোগ করার আগে প্রমাণের দায়িত্ব কার? বারবার একই ধাঁচের অপপ্রচার চালিয়ে একটি বাহিনী ও রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নয়, বরং ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড।
প্রকৃত মানবিক ভূমিকা কোথায়?
যদি ইয়েন ইয়েন সত্যিই নিরীহ বম নারীদের পাশে দাঁড়াতে চান, তাহলে তার উচিত— মামলা সংশ্লিষ্ট আইনি সহায়তা প্রদান; নিরীহদের জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণসহ প্রশাসনের কাছে আবেদন; KNF এর সঙ্গে যারা জড়িত নয় তাদের সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করে সরবরাহ; KNF-এর গঠনতন্ত্র, কার্যক্রম ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়া।
জাতিসংঘে নারী উন্নয়ন নিয়ে রিপোর্ট পাঠানো এবং দেশে বিভ্রান্তিকর পোস্ট দেওয়ার মধ্যকার বৈপরীত্য কি সরকারের নয়, বরং ইয়েন ইয়েনের কাজেই বেশি প্রতিফলিত হয় না? তাঁর মতো ব্যক্তির উচিত পাহাড়ের সমস্ত নারী ও শিশুর জন্য নিরপেক্ষভাবে কাজ করা। অথচ তিনি এখন ‘বম নারী’ ইস্যুকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।
পরিশেষে, সেনাবাহিনী, পুলিশ বা প্রশাসন কোনো জাতি বা সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে সমষ্টিগতভাবে দমন করতে চায় না। রাষ্ট্র ও সংবিধান সব নাগরিকের জন্য সমান। যাদের বিরুদ্ধে KNF সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, তাদের নিশ্চয় আইনি সহায়তা দেওয়া উচিত। কিন্তু বিচারাধীন বিষয়কে একতরফা আবেগ দিয়ে ঢেকে দিয়ে রাষ্ট্র ও বাহিনীকে কলঙ্কিত করার অপপ্রয়াস কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
আসুন, মানবাধিকার রক্ষা করি বাস্তবতা, তথ্য ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে—শুধু আবেগ নয়, উদ্দেশ্য নয়।
লেখক: অনন্ত অসীম ব্লগার ও মানবাধিকার কর্মী পার্বত্য চট্টগ্রাম।