পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অনন্য ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চল, যেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে বাঙালি এবং চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, খুমি, লুসাই প্রভৃতি উপজাতি বসবাস করে। এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতিগুলোর মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ে চাকমাদের একটি অংশ নিজেদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জোরালোভাবে উত্থাপন করছে। এই দাবি শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক পরিচয়ের বিষয় নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট। এই দাবির ঐতিহাসিক অগ্রাহ্যযোগ্যতা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, এবং জাতীয় স্বার্থে এর বিপদজ্জনক পরিণতি নিয়েই এই আলোচনায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
চাকমাদের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়, চাকমাদের আদি নিবাস মায়ানমারের চম্পকনগর অঞ্চল এবং মঙ্গোলিয়া। মোগল ও ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মা ও ভারত থেকে বিভিন্ন কারণে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শরণার্থী হিসেবে আগমন করে। ঐতিহাসিক দলিল অনুসারে, চাকমারা এই অঞ্চলে ২০০-৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছে না। এই সময়ের তুলনায় বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে বসবাসের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। তাই তাদের আদিবাসী দাবি একটি প্রশ্নবিদ্ধ প্রচারণা হিসেবেই প্রতীয়মান হয়।
ভারতের অরুণাচল প্রদেশে বসবাসরত চাকমাদের নাগরিকত্ব নেই, এবং তারা সেখানেও আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত নয়। ভারতীয় সংবিধান উপজাতিদের ‘তফসিলি জনজাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় না। একইভাবে, বাংলাদেশের সংবিধানও ‘নৃগোষ্ঠী’ বা ‘উপজাতি’ হিসেবে উল্লেখ করে, কিন্তু আদিবাসী হিসেবে কোনো স্বীকৃতি প্রদান করে না। এই প্রেক্ষাপটে তাদের দাবি কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক নয়, বরং একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
চাকমাদের আদিবাসী দাবি শুধুমাত্র পরিচয়ের বিষয় নয়, এর পেছনে রয়েছে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমারা ঐতিহাসিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯৭০-এর দশকে জেএসএস সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর নেতৃত্বে তারা সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে, যা ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে আংশিক সমাপ্ত হয়। এই চুক্তি চাকমাসহ পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতিদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও আঞ্চলিক পরিষদের বদৌলতে স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করে। তবুও চাকমাদের একটি অংশ এখনো বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব পোষণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০০৭ সালে জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র প্রকাশের পর থেকে চাকমারা তাদের আদিবাসী দাবিকে আরও জোরালোভাবে উত্থাপন করছে। তারা পার্বত্য চুক্তি ও বাংলাদেশের সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে এই দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এই প্রচারণার পেছনে দেশি-বিদেশি এনজিও এবং মিশনারি গোষ্ঠীর অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ উঠেছে। এই প্রশ্নবিদ্ধ প্রচারণা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ করা ও বাঙালি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার মতো উদ্দেশ্য বহন করছে বলে অনেকে মনে করেন।
চাকমারা নিজেদের ‘জুম্ম’ জাতীয়তাবাদের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। ‘জুম্ম’ শব্দটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের একটি সম্মিলিত পরিচয় হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে একটি একচ্ছত্র জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে কাজ করছে। তবে এই জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে চাকমারা অন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী যেমন মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, খুমি প্রভৃতির স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই প্রবণতা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভাজন ও সংঘাতের বীজ বপন করছে।
এই জুম্ম জাতীয়তাবাদের পেছনে চাকমা সশস্ত্র সংগঠন বা নেতাদের প্রভাব স্পষ্ট। তারা বিভিন্ন প্রকল্প ও অর্থায়নের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীগুলোকে প্রভাবিত করছে। এই প্রভাবের ফলে অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব পরিচয় হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশে চাকমাসহ অন্যান্য উপজাতি জনগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। শিক্ষা, চাকরি ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে তাদের জন্য কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। যদিও চাকমারা সর্বক্ষেত্রেই আধিপত্য বিস্তার করায় অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে থাকে। পার্বত্য উপজাতিরা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করে। পার্বত্য চুক্তির ফলে এই অঞ্চলের উপজাতিদের জন্য বিশেষ প্রশাসনিক ও আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সুবিধাগুলো বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বিরল।
তবুও চাকমাদের একটি অংশ এই সুবিধাগুলোকে অগ্রাহ্য করে বিতর্কিত ও অতিরঞ্জিত দাবি উত্থাপন করছে। তাদের আদিবাসী দাবিকে অনেকেই বাস্তবতা ও ইতিহাসবিরুদ্ধ এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন।
‘আদিবাসী’ শব্দটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিতর্কিত। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার এই শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং উপজাতিদের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বা ‘উপজাতি’ জাতিসত্তা হিসেবে উল্লেখ করার নির্দেশনা দেয়। সরকারের এই অবস্থানের পেছনে ছিল আদিবাসী শব্দের রাজনৈতিক ও আইনি জটিলতা। এই শব্দ ব্যবহারের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব উসকে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠী এই শব্দটি পুনরায় ব্যবহার শুরু করেছে। এটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য অশুভ ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে, আদিবাসী দাবির সঙ্গে সেনা প্রত্যাহারের দাবি যুক্ত হওয়ায় এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চাকমাদের আদিবাসী দাবি এবং এর সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রচারণা বর্তমানে একটি প্রশ্নবিদ্ধ এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এর পেছনে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর সমর্থন এই ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই এই বিষয়ে সরকার, নাগরিক সমাজ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
চাকমাদের আগমনের ইতিহাস ও বাংলাদেশের আদিম বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিষয়ে সঠিক তথ্য প্রচার করা প্রয়োজন। এটি মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পার্বত্য অঞ্চলে এনজিও ও মিশনারি গোষ্ঠীর কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। তাদের অর্থায়নের উৎস ও উদ্দেশ্য স্বচ্ছ করা প্রয়োজন। পার্বত্য অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীকে জাতীয় মূলধারায় সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব প্রতিরোধ করা যেতে পারে। আদিবাসী শব্দ ব্যবহারের বিষয়ে সরকারের অবস্থান আরও স্পষ্ট করা উচিত। এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভ্রান্তি কমাতে সাহায্য করবে।
চাকমাদের আদিবাসী দাবি: ঐতিহাসিক তথ্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের অন্তরালে একটি প্রশ্নবিদ্ধ প্রচারণা—এই দাবির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অনুধাবন করে যথাযথ নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। দেশের সার্বভৌমত্ব ও সামাজিক ঐক্য রক্ষায় এই ইস্যুটি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।
অনন্ত অসীম | রাঙামাটি