অপহৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তিতে জেএসএসের প্রতি ইউপিডিএফের শর্ত।

0

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান—এই তিন জেলা তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা বিচ্ছিন্নতাবাদের কবলে এবং সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় অঞ্চল, দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। এই অঞ্চলের প্রধান দুটি সংগঠন—জন সংহতি সমিতি (জেএসএস), যার নেতৃত্বে রয়েছেন সন্তু লারমা, এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রসীত বিকাশ খীসা—দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এই সংঘাত শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, বরং অঞ্চলের সম্পদ, ভূমি এবং জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি লড়াই।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা জাগলেও, জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এই সম্ভাবনাকে বারবার ম্লান করে দিয়েছে। চুক্তি নিয়ে মতপার্থক্য, স্থানীয় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এবং অঞ্চলভিত্তিক আধিপত্য এই সংঘাতের মূল কারণ। এই প্রেক্ষাপটে, ২০১৮ সালে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা দীর্ঘদিনের সংঘাতে সাময়িক বিরতি এনেছিল। তবে, এই চুক্তি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে, ২০২১ সালের পর থেকে হত্যা, অপহরণ ও গোলাগুলির মাধ্যমে শান্তি বিনষ্ট করে এবং সাম্প্রতিক অপহরণের ঘটনা এই অস্থিরতার একটি প্রকট উদাহরণ।

২০১৮ সালের অস্ত্রবিরতি চুক্তি, শর্ত ও প্রেক্ষাপট:
২০১৮ সালের জুন মাসে জেএসএস এবং ইউপিডিএফ একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিনের সশস্ত্র সংঘাতে বিরতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলো ছিল:

১. অঞ্চল ও এলাকা ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র বন্ধ: ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলায় জেএসএসকে তাদের সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে ধুধুকছড়া, যা অস্ত্র চালানের প্রধান পথ হিসেবে পরিচিত, সেখানে জেএসএসের সশস্ত্র উপস্থিতি বন্ধ করতে হবে।

২. নির্বাচনী সমঝোতা: নির্বাচনে এক পক্ষের প্রার্থীকে অন্য পক্ষ সমর্থন করবে। অর্থাৎ, যে এলাকায় ইউপিডিএফ প্রার্থী দেবে, সেখানে জেএসএস প্রার্থী দেবে না এবং উল্টোপক্ষেও একই নীতি প্রযোজ্য হবে।

৩. সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঐক্য: গুরুত্বপূর্ণ সরকারবিরোধী আন্দোলনে জেএসএস এবং ইউপিডিএফ একসঙ্গে কাজ করবে।

৪. আক্রমণ নিষিদ্ধকরণ: এক পক্ষ অন্য পক্ষের উপর আক্রমণ করবে না এবং পারস্পরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

৫. এক এলাকায় অন্য পার্টির লোকজনের আসা-যাওয়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে নিজেদের এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড যে যার মতন পালন করে থাকবে।

এই চুক্তির ফলে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটির কুতুকছড়িতে ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার প্রকাশ্যে প্রচারণা চালান। সেখানে ইউপিডিএফ অংশ গ্রহণ করে। এটি ছিল দুই পক্ষের মধ্যে সহযোগিতার একটি বিরল উদাহরণ। তবে, এই সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

চুক্তি ভঙ্গের কারণ ও জেএসএসের অবস্থান:
জেএসএস এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ ছিল তাদের মতে অঞ্চলের সিনিয়র সংগঠন হিসেবে তাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত না হওয়া। চুক্তিতে উভয় পক্ষকে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, যা জেএসএসের জন্য গ্রহণযোগ্য ছিল না। জেএসএস মনে করত যে, পাহাড়ি অঞ্চলের আন্দোলন তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া উচিত। কিন্তু ইউপিডিএফ এই শর্ত মানতে অস্বীকৃতি জানায়, ফলে জেএসএস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়।

এই বিভেদের ফলে পানছড়ি এবং বাঘাইছড়ি অঞ্চলে পুনরায় সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়। জেএসএস তাদের পূর্বের দখলকৃত এলাকাগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য তথাকথিত “ধর্মযুদ্ধে” জড়িয়ে পড়ে, এবং ইউপিডিএফও তাদের অবস্থান ধরে রাখতে একই পথে হাঁটে। বারবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দিয়ে “ইউপিডিএফ ভাঁওতাবাজি করেছে মনে করে জেএসএস সমর্থরা। এই সংঘাতের ফলে দুই পক্ষের সদস্য এবং সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছে, এবং অঞ্চলটি আবারও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।

গত ১৬ এপ্রিল ২০২৫, খাগড়াছড়ির গিরিফুল এলাকায় একটি মর্মান্তিক অপহরণের ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের পাঁচজন শিক্ষার্থী এবং একজন টমটম চালককে ইউপিডিএফ সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃক অপহরণ করা হয়। অপহৃত শিক্ষার্থীরা হলেন:
১। মৈত্রীময় চাকমা (চারুকলা বিভাগ)
২। দিব্যি চাকমা (নাট্যকলা বিভাগ)
-৩। রিশন চাকমা (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ)
৪। লংঙি ম্রো (প্রাণীবিদ্যা বিভাগ)
৫। অলড্রিন ত্রিপুরা (চারুকলা বিভাগ)

এই শিক্ষার্থীরা বিজু উৎসব শেষে খাগড়াছড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন। তাদের গন্তব্য ছিল শিক্ষার আলো, কিন্তু গিরিফুলের পাহাড়ি পথ তাদের জীবনে একটি অনিশ্চিত বাঁক হয়ে দাঁড়ায়।

ইউপিডিএফের প্রচার সেলগুলো এই শিক্ষার্থীদের জেএসএস-ঘনিষ্ঠ বলে চিহ্নিত করে অপহরণকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং তাদের বিগত সাংগঠনিক তৎপরতা তুলে ধরছে। পাঁচজন পাহাড়ি শিক্ষার্থীর মধ্যে রিশন চাকমাসহ দুজন জেএসএস-ঘনিষ্ঠ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ছাত্রনেতা, বাকি তিন শিক্ষার্থী নিরীহ। কিন্তু সবাইকে জেএসএস তকমা দেওয়ার উদ্দেশ্য কী?
যা থেকে স্পষ্ট এই অপহরণের সঙ্গে ইউপিডিএফ জড়িত। এ নিয়ে আরো প্রশ্ন তৈরি হয়েছে শিক্ষার্থীরা যদি সবাই জেএসএস সহযোগী অঙ্গসংগঠনে যুক্ত থাকে তাহলে টমটম চালক কী ছিল? তাকে কেন অপহরণ করা হল? তার অপরাধ কি ছিল? নাকি জেএসএস তকমা দিয়ে তাদের অপহরণকে বৈধ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে?

একটি গোপন সূত্র থেকে জানা গেছে এই অপহরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ২০১৮ সালের অস্ত্রবিরতি চুক্তি পুনরায় কার্যকর করা বা নতুন চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য জেএসএস উপর চাপ সৃষ্টি করা। এজন্য ইউপিডিএফ অপহরণ করেছে।

অপহরণের ঘটনার পর ইউপিডিএফ তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একপর্যায়ে ইউপিডিএফ এর একাংশ মুক্তিপণের বিনিময়ে অপহৃতদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রথমে সম্মত হলেও, তাদের হাইকমান্ড দ্বিমতের কারণে এই প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়। ইউপিডিএফ হাইকমান্ড চাচ্ছে ২০১৮ সালের অস্ত্র বিরতি সমঝোতা চুক্তি জেএসএস মানলেই কেবল মুক্তি মিলতে পারে অপহৃতদের। ইউপিডিএফ-এর পক্ষ থেকে সমঝোতা চুক্তির শর্ত জেএসএস কাছে পৌছানো হয়েছে বলে গোপন সূত্রে জানা গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জেএসএস পানছড়ি ও ধুধুকছড়ার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে আসবে বলে মনে হয় না। এছাড়াও ইউপিডিএফ এর সঙ্গে চুক্তিকে জেএসএস আত্মমর্যাদা পরিপন্থি মনে করে। কারণ জেএসএস মনে করে পার্বত্য চুক্তির জন্য সবচেয়ে বড় বাধা ইউপিডিএফ। তাই তাদের পক্ষে ২০১৮ সালের চুক্তি মানা কঠিন।

অপহৃত শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলো চরম আতঙ্কে রয়েছে। তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা শঙ্কিত। ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তারা অপহৃতদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে এবং তাদের বারবার স্থান পরিবর্তন করছে, যা তাদের নিরাপত্তার জন্য আরও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইউপিডিএফের অপহরণের ইতিহাস নতুন নয়। ২০০১ সালে তারা তিনজন বিদেশী নাগরিককে অপহরণ করে এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ৩ কোটি টাকা মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। এই ঘটনা ইউপিডিএফের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের একটি অংশ হিসেবে দেখা হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তারা একটি জাতীয় রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ দাবি করে অপহরণ, খুন, গুম এবং চাঁদাবাজির মাধ্যমে পাহাড়ে তাদের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এই কৌশল তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ালেও, স্থানীয় জনগণের মধ্যে ভয় ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।

জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে চলমান সংঘাত পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৮ লাখ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে। এই অঞ্চলের শান্তি, সম্প্রীতি এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অপহৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তির জন্য জেএসএস এবং ইউপিডিএফের একাংশ কাজ করছে বলে জানা গেছে। তবে, দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব শান্তি প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।সূত্রে জানা গেছে পাঁচ শিক্ষার্থীকে ইউপিডিএফ অপহরণ করার পর জেএসএস নিয়ন্ত্রণ রাঙামাটি ও অধ্যুষিত এলাকা ইউপিডিএফ সদস্য ও সমর্থকরা এড়িয়ে চলছে। তবে অপহৃত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে জেএসএস পরিস্থিতি পর্যাবেক্ষণ করছে বলে জানা গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সংঘাত এবং অপহরণের ঘটনা এই অঞ্চলের জনগণের জন্য একটি মর্মান্তিক বাস্তবতা। জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র তাদের নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সাধারণ মানুষের জীবন, শিক্ষা এবং নিরাপত্তার উপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

সচেতন মহল মনে করেন, অপহৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি এবং পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ, পারস্পরিক সমঝোতা এবং তাদেরকে নিরস্ত্রকারণে সরকারের সক্রিয় হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।

পাঁচ শিক্ষার্থীর মুক্তির বিষয়ে জেএসএস সন্তু ইউপিডিএফ প্রসীতের সঙ্গে আপস করবে কিনা সময়ই বলে দেবে, পাহাড়ের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে—শান্তির পথে, নাকি আরও অস্থিরতার দিকে।

আগের পোস্টবান্দরবানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ও সুধী সমাবেশ।
পরের পোস্টমারমা তরুণী ধর্ষণ ঘটনায় স্বজাতিকে আড়াল, বাঙালিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন