হিলনিউজবিডি, আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ২২ এপ্রিল ২০২৫:
জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের (UNPFII) ২৪তম অধিবেশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) প্রতিনিধি অগাস্টিনা চাকমা যে বক্তব্য রেখেছেন, তা শুধু মিথ্যাচার ও তথ্য বিকৃতির দৃষ্টান্ত নয়, বরং এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রবিরোধী প্রোপাগান্ডার (প্রচারণা) অংশ বলেই প্রতীয়মান হয়।
অগাস্টিনা তার বক্তব্যে যে শব্দটি বারবার ব্যবহার করেছেন—”আদিবাসী”—তা বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট: পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠী “উপজাতি” হিসেবে সংজ্ঞায়িত (সংবিধান ২৩ ক অনুচ্ছেদ)। অথচ জেএসএসসহ কতিপয় গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই অসাংবিধানিক পরিচয় তুলে ধরে শুধু বাংলাদেশকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং পার্বত্য এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিতকে দুর্বল করার অপচেষ্টা করছে।
অগাস্টিনার পরিচয় ও উদ্দেশ্য—
উল্লেখ্য, অগাস্টিনা চাকমা বর্তমানে কানাডায় বসবাস করছেন এবং সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। তার পশ্চিমা জীবনধারা, পোশাক, সামাজিক আচরণ—সবকিছুই উপজাতি সংস্কৃতির পরিপন্থী। অথচ তিনি নিজেকে জুম্ম নারী হিসেবে উপস্থাপন করে সেই জনগোষ্ঠীর পক্ষে মিথ্যা বার্তা প্রচার করছেন, যাদের বাস্তব জীবনযাপন, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি দূরবর্তী ধারণা রাখেন।
২০২২ সালের একই অধিবেশনে তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে প্রথম আলোচনায় আসেন। তার সে বক্তব্য নিয়ে পাহাড়ের মানুষ তার প্রশংসার চেয়েই সমালোচনা বেশি করেন। তখন তার কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তার খোলামেলা পোষাক পাহাড়ি সমাজেও বেমানান ছিল।
অগাস্টিনার বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য হলো সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো এবং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করা। অথচ বাস্তবতা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় একান্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। অবৈধ অস্ত্রধারী গোষ্ঠীর হুমকিতে যখন সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে মানুষ বিপন্ন, তখন সেনাবাহিনীই সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা রাখে।
ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ ও বাস্তবতা—
অগাস্টিনা তার বক্তব্যে বান্দরবানে কথিত ধর্ষণের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যেখানে মো: জামাল হোসেন নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয় এবং সেনা কর্মকর্তা মেজর সারোয়ারের বিরুদ্ধে আপোষে নিষ্পত্তির চাপ দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়।
তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১০ মার্চের ঘটনায় ধর্ষণের ঘটনা নয়, ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল। জামালকে এলাকাবাসী স্থানীয়ভাবে মারধর করে, মাথার চুল কেটে, গলায় জুতা পরিয়ে ঘোরায়—যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম দৃষ্টান্ত। এরপর পুলিশ আইন অনুযায়ী জামালকে গ্রেফতার করে এবং মামলা দিয়ে আদালতে পাঠান। সেনাবাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডার সারোয়ার শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এড়াতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় অংশ নেন। কিন্তু তাকে এই ঘটনার মীমাংসা করার জন্য দায়ী করা সম্পূর্ণ অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে বিভ্রান্তি—
অগাস্টিনা অভিযোগ করেন যে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে জুম্ম নারীরা ক্ষমতায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ বাস্তবতা হলো, সরকার পর্যায়ক্রমে চুক্তির অনেক ধারা বাস্তবায়ন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে উপজাতি সম্প্রদায়ের উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ ও কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা হলো—জেএসএস, ইউপিডিএফ, এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুন।
২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অন্তত ৫০০টির বেশি অপহরণ, চাঁদাবাজি ও খুনের ঘটনায় আঞ্চলিক দলের সদস্যদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এই বাস্তবতায় সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।
ক্যাপে ফাউন্ডেশন ও তথাকথিত মানবাধিকারকর্মীদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ—
অগাস্টিনার পক্ষে অবস্থান নেওয়া ‘ক্যাপে ফাউন্ডেশন’ নামক প্রতিষ্ঠানটির সাথে চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের স্ত্রী ইয়েন ইয়েন সরাসরি জড়িত। উল্লেখ্য, ইয়েন ইয়েন বিগত বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে আন্তর্জাতিক ফোরামে “আদিবাসীদের দমন এলাকা” হিসেবে উপস্থাপন করে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন, যার যথার্থ কোনো ভিত্তি ছিল না।
তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা, সেনাবাহিনীকে হেয় করা এবং তথাকথিত আদিবাসী পরিচয়ের আড়ালে রাষ্ট্রবিরোধী চক্রের এজেন্ডা বাস্তবায়ন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির অধিকার অনস্বীকার্য—
অগাস্টিনা তাদের বক্তব্যে বাঙালিদের “সেটেলার” বলে অভিহিত করেছেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাদের অপসারণের প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি সরাসরি সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক দেশের যেকোনো অংশে বসবাসের অধিকার রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা বৈধভাবে বসবাস করে, তাদের উচ্ছেদের দাবি ঘৃণাজনক এবং সাংবিধানিক অবমাননার শামিল।
বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন—
অগাস্টিনা চাকমার মতো প্রবাসী প্রতিনিধি, যারা নিজের সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে মিথ্যাচার করে, তাদের বক্তব্য দেশের মানুষের অনুভূতি আঘাত করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন, শান্তি, এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই ভূমিকা ব্যাহত করতে যারা তথ্যসন্ত্রাস চালায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
সতর্কবার্তা: অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। তথ্য যাচাই ছাড়া আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপিত বক্তব্যকে বিশ্বাস না করে বরং রাষ্ট্রীয় সত্য তথ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।