অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি: ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ কী বলে?
অন্তত অসীম
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জনগণ:
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জনগণ, যাদের মধ্যে অ্যাবোরিজিনিস এবং টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডারস অন্যতম, পৃথিবীর প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুসারে, তারা প্রায় ৬০,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে বসবাস করে আসছে। এই জনগণের দুটি প্রধান গোষ্ঠী: অ্যাবোরিজিনিস, যারা মূল ভূখণ্ডে বাস করে, এবং টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডারস, যারা কুইন্সল্যান্ডের উত্তরে টরেস স্ট্রেইট দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করে।
অ্যাবোরিজিনিস:
অ্যাবোরিজিনিসরা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত। তাদের জীবনধারা পরিবেশের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত, যেমন শিকার, মৎস্য আহরণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ। তাদের সংস্কৃতি ড্রিমটাইম (Dreamtime) নামক সৃষ্টি-কাহিনীর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা তাদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, ইতিহাস এবং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তি। ড্রিমটাইমের গল্পগুলো গান, নৃত্য এবং শিল্পের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়।
টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডারস:
টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডারসদের সংস্কৃতি মেলানেশীয় এবং পলিনেশীয় প্রভাবের সংমিশ্রণ। তাদের জীবনধারা সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে মৎস্য শিকার এবং নৌযান নির্মাণ। তাদের ভাষা, শিল্প এবং নৃত্য অ্যাবোরিজিনিসদের থেকে স্বতন্ত্র, তবে তারা একইভাবে প্রকৃতি ও পূর্বপুরুষের সঙ্গে গভীর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক বজায় রাখে।
ভাষা ও সংস্কৃতি:
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের প্রায় ২৫০টি ভাষা ছিল, যার মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১২০টি ভাষা টিকে আছে, এবং অনেকগুলো বিলুপ্তির পথে। তাদের শিল্পকর্ম, যেমন গুহাচিত্র, শরীরে অঙ্কন এবং বাকল পেইন্টিং, তাদের ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলন। তাদের কিনশিপ (আত্মীয়তা) ব্যবস্থা সমাজের কাঠামো নির্ধারণ করে, যেখানে দায়িত্ব ও সম্পর্ক সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টন করা হয়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
১৭৮৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের পর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা তাদের ভূমি, সংস্কৃতি এবং জনসংখ্যার ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জোরপূর্বক ভূমি দখল, সংক্রমণ রোগ এবং সাংস্কৃতিক দমন তাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে। ২০ শতকের শুরুতে, “স্টোলেন জেনারেশন” নীতির অধীনে অনেক আদিবাসী শিশুকে তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে, ১৯৯২ সালের মাবো রায় এবং ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুডের ক্ষমা প্রার্থনা আদিবাসী অধিকার পুনরুদ্ধারের দিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বর্তমানে, তারা ভাষা, ভূমি এবং সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি: ইতিহাস ও আদিবাসী দাবি এবং বসবাসের ইতিহাস—
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতিদের ইতিহাস তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, পাংখো, খুমি, চাক, লুসাই এবং খিয়াংসহ ১১টি প্রধান উপজাতি বসবাস করে। তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন মূলত ১৬শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যে ঘটে, যা প্রায় ৩০০-৫০০ বছরের পুরনো।
চাকমা: চাকমারা প্রায় ৩০০-৪০০ বছর আগে মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে এবং পরে কক্সবাজার হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে তারা রাঙামাটিতে বসতি স্থাপন করে।
মারমা: মারমারা ১৬৩৮ সালে আরাকানের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে, প্রাথমিকভাবে বার্মার পেগু অঞ্চল থেকে।
ত্রিপুরা: ত্রিপুরারা ১৮শ শতাব্দীতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে।(https://www.jagonews24.com/opinion/article/602780)
এই উপজাতিরা নৃতাত্ত্বিকভাবে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত এবং তাদের আদিনিবাস মূলত মিয়ানমার (আরাকান), ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং থাইল্যান্ডের কিছু অংশে ছিল। ঐতিহাসিক প্রমাণে দেখা যায়, তারা এই অঞ্চলের “আদি” বাসিন্দা নয়, বরং অভিবাসী।
ভাষার সংখ্যা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের মধ্যে প্রায় ৫-৬টি ভাষা প্রচলিত, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, এবং লুসাই ভাষা। এই ভাষাগুলো সিনো-তিব্বতি, অস্ট্রো-এশিয়াটিক এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।(https://en.wikipedia.org/wiki/Ethnic_minorities_in_Bangladesh)
বাঙালি বসবাসের ইতিহাস-
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বাঙালি নৃগোষ্ঠীর উদ্ভব প্রায় ৪,০০০ বছরের পুরনো। নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আর্যদের মিশ্রণে বাঙালি জাতি গড়ে ওঠে। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে এই অঞ্চলে অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল, এবং পরবর্তীতে দ্রাবিড় ও আর্যদের আগমন ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও বাঙালি বসবাসের ইতিহাস উপজাতিদের তুলনায় অনেক পুরনো, যা খ্রিস্টপূর্ব যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত।
উপজাতি বসবাসের ইতিহাস:
উপজাতিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসের ইতিহাস ৩০০-৫০০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা বাঙালি বসবাসের তুলনায় অনেক কম। তাদের আগমন মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক কারণে ঘটে।
আদিবাসী দাবি: ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ:
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেদের “আদিবাসী” হিসেবে দাবি করে আসছে, যা ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে বিতর্কিত। “আদিবাসী” শব্দটি সাধারণত এমন জনগোষ্ঠীকে বোঝায় যারা কোনো অঞ্চলের প্রাচীনতম বাসিন্দা এবং যাদের উৎপত্তি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য নেই।
ঐতিহাসিক সত্যতা এবং অভিবাসী পরিচয়: ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা মিয়ানমার, ভারত এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে অভিবাসী হিসেবে এসেছে। তথ্য সূত্র: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (৫৩), তাদের বসবাসের ইতিহাস ৫০০ বছরের বেশি পুরনো নয়, যেখানে বাঙালি এবং অন্যান্য আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠীর বসবাস হাজার বছরেরও বেশি।
আদিবাসী সংজ্ঞার অসঙ্গতি: জাতিসংঘের আদিবাসী সংজ্ঞা অনুযায়ী, আদিবাসীদের স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস এবং স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় থাকতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা এই সংজ্ঞার সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না, কারণ তাদের আগমনের ঐতিহাসিক তথ্য সুনির্দিষ্ট।
বাঙালির আদিবাসী পরিচয়: কিছু ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক বক্তব্যে বলা হয়, বাঙালিরাই এই অঞ্চলের প্রকৃত আদিবাসী, কারণ তাদের বসবাসের ইতিহাস অনেক পুরনো এবং তারা এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ভাষার প্রধান বাহক।
সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি:
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি করছে, যা বাংলাদেশ সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারের অবস্থান হলো, এই জনগোষ্ঠী “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী” বা “উপজাতি” হিসেবে পরিচিত, এবং তাদের আদিবাসী বলা ঐতিহাসিকভাবে অসঙ্গত। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জেলা পরিষদ আইন উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের কথা বলা হলেও “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি?
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, আদিবাসী দাবির পিছনে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে, জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র (UNDRIP) অনুযায়ী এই জনগোষ্ঠী ভূমি, স্ব-শাসন এবং অন্যান্য অধিকার দাবি করতে পারে, যা বাংলাদেশের জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক এনজিও এবং মিশনারি গোষ্ঠী এই দাবিকে উসকে দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত হয়েছে, যা অঞ্চলটিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ:
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের তুলনা করলে দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বসবাসের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের, এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভাষা স্মরণাতীত কাল থেকে বিদ্যমান। পক্ষান্তরে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের ইতিহাস তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক এবং তাদের অভিবাসনের তথ্য ঐতিহাসিকভাবে নথিভুক্ত। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা তাদের ভূমি ও সংস্কৃতি হারানোর পরও আইনগত ও সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের উপজাতিদের আদিবাসী দাবি ঐতিহাসিক তথ্যের অভাবে বিতর্কিত।
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জনগণ এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আদিবাসী দাবির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা প্রাচীনতম বাসিন্দা হিসেবে স্বীকৃত এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পৃথিবীব্যাপী সম্মানিত। অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের অভিবাসী পরিচয় এবং তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক ইতিহাস তাদের আদিবাসী দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই দাবির পিছনে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যা অঞ্চলটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি হতে পারে। তবে, তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য সরকারের উচিত সংবিধানের আলোকে ন্যায্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে উপজাতি ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হয়।