অনন্ত অসীম
বিকেল ঘনিয়ে এসেছিল। আকাশে সূর্য তখনও অস্ত যায়নি, তবে আলো হয়ে উঠেছিল ম্লান। ঠিক সেই গোধূলিলগ্নেই ইতিহাসের রক্তাক্ত পৃষ্ঠায় এক নতুন কলঙ্ক রচিত হয়। ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে—পবিত্র মাহে রমজানের এক বৃহস্পতিবার রাঙামাটির লংগদু উপজেলার বাঙালি জনমানসে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং নেতৃত্বগুণে অভিসিক্ত উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকারকে নির্মমভাবে হত্যা করে তথাকথিত শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বরাবরই বাঙালি নিধনযজ্ঞের পরীক্ষাগাররূপে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, যেখানে সংহতির বদলে ষড়যন্ত্র, সহাবস্থানের পরিবর্তে বিভাজন, এবং সম্প্রীতির স্থলে রক্তস্নাত হত্যাযজ্ঞ নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথাকথিত ‘শান্তিবাহিনী’ নামক সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যাদের প্রকৃত পরিচয় ‘অগ্নিদ’, ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘বাঙালিবিদ্বেষী’ উপাধিতেই অধিকতর সংগত, তারা দীর্ঘদিন ধরে বাঙালিদের উৎখাতের সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ও অমর্ষণ (তীব্র ক্রোধ) দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
তৎকালীন জনপ্রিয় নেতা আব্দুর রশিদ সরকার ছিলেন লংগদু উপজেলার প্রথম নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান। দণ্ডায়মান শান্তিবাহিনীর চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক ‘অসিক্নী’ প্রতীক—যিনি বয়স ও ভয় উভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে বাঙালির অধিকার ও অস্তিত্বের পক্ষে সরব ছিলেন। তাঁর এই অনপেক্ষাকারী (স্বনির্ভর) চরিত্রই হয়তো তাঁর মৃত্যুদণ্ডের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মাইনী বাজার সফর শেষে লংগদু সদরের পথে তাঁর উপর চলানো হয় অতর্কিত ও সুপরিকল্পিত আঘাত। কাঠালতলীর অদূরে বর্তমান বনবিহার গেটের কাছে সশস্ত্র শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা তাঁকে লক্ষ করে গুলি বর্ষণ করে। একটি বুলেট তাঁর অঙ্গসৌষ্ঠব ভেদ করে হৃদপিণ্ড ছিন্ন করে দেয়। মুহূর্তেই নিথর হয়ে পড়ে থাকে রাষ্ট্রের এক অক্লিষ্টকর্মা (নিরবিচারে কর্মনিবেদিত) সন্তান।
এই হত্যাকাণ্ড ছিল নিছক একটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং সমগ্র পার্বত্য বাঙালির ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে এক সর্বনাশা অগ্নিসংযোগ। যেই মুহূর্তে বাঙালিরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে, তখনই পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী আবারও গুলিবর্ষণ করে; বহু নিরীহ বাঙালি প্রাণ হারায়। এই ঘটনাটি ইতিহাসে ‘লংগদু গণহত্যা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে—এক কলঙ্কিত দিন, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের বুক চিরে আজও আর্তনাদ করে।
উল্লেখ্য, এই হত্যাযজ্ঞের পূর্বাপর বহু গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। গবেষণা বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ছোট-বড় প্রায় ৪৬টি গণহত্যার তথ্য পাওয়া যায়। লংগদু ও পাকুয়াখালির ৩৫ কাঠুরিয়ার গণহত্যা তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সবগুলোতেই লক্ষ্য ছিল একটাই—পার্বত্যাঞ্চল থেকে বাঙালিকে চিরতরে নির্মূল করা।
তৎকালীন সময়ে তথাকথিত শান্তিবাহিনী কেবল অস্ত্রের নয়, প্রচারের মাধ্যমেও এক অধিপত্য কায়েম করে। তারা গণমাধ্যমে সেন্সর আরোপ করে, বাঙালিদের নিধনযজ্ঞ ধামাচাপা দিতে সচেষ্ট হয়। বহু ভয়াল গণহত্যা মূলধারার সংবাদপত্রে স্থান পায়নি। এ যেন এক অপদহ্নব (প্রকাশ্য বিষয়কে গোপন করা) প্রবণতা, যা তথাকথিত মানবাধিকারের মুখোশ পরিহিত সংগঠনগুলোকেও নীরব দর্শকে পরিণত করে। এজন্যই আব্দুর রশিদ সরকার হত্যা ঘটনাকে বলা হয় রক্তাক্ত প্রহেলিকা।
আরও দুঃখজনক ও বিপজ্জনক বাস্তবতা হলো, এই গণহত্যার ৩ যুগ অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। পার্বত্য শান্তিচুক্তির অসাংবিধানিক ও বিতর্কিত ধারার আড়ালে দেশদ্রোহী শান্তিবাহিনী সন্ত্রাসীরা পায় দায়মুক্তি। ‘HBF’-এর মতে, এ চুক্তি কার্যত ৩৫ হাজার বাঙালি হত্যার দায় থেকে জেএসএস ও ইউপিডিএফকে অব্যাহতি দিয়েছে। যা নিঃসন্দেহে এক ‘অপমানসিক্ত ন্যায়বিচারহীনতা’।
আজও শান্তিবাহিনীর অনুসারীরা, বিশেষত ইউপিডিএফ, ইতিহাস বিকৃতি ও মিথ্যাচার করে চলেছে। তাদের দাবি, ১৯৮৯ সালের এই দিনে নাকি বাঙালিরা সেনাবাহিনী ও ভিডিপির সহায়তায় পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়, ঘরবাড়ি ও বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করে। অথচ প্রকৃত সত্য হলো—এই দিনেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন নির্মমভাবে নিহত হন। পাহাড়ে বাঙালিদের উপর শান্তিবাহিনীর নিষ্ঠুরতা এতটাই ভয়াবহ যে, আজও হাজারো পরিবার সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা বাঙালি হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল, তাদের চরম শাস্তি দাবি করছি। এইসব অধিবেত্তা (স্ত্রী থাকতেও যিনি পরস্ত্রী গ্রহণ করেন)-সুলভ দ্বিমুখী চরিত্রের নেতানেত্রী ও সন্ত্রাসীরা কখনোই এদেশের বুকে অবস্থান করার নৈতিক অধিকার রাখে না। তারা যুগে যুগে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাঙালি নিধনের অব্যাহত প্রয়াস চালিয়ে গেছে। একমাত্র কঠোর বিচারের মাধ্যমেই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
আমরা রাষ্ট্রের নিকট জোরালোভাবে দাবি জানাই— ১. লংগদুতে আব্দুর রশিদ সরকার হত্যাকাণ্ডসহ সকল বাঙালি হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ২. স্বজনহারানো পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৩. পার্বত্য চুক্তির অসাংবিধানিক ধারাগুলো বাতিল করতে হবে। ৪. বাঙালিদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পার্বত্য এলাকায় সেনা সদস্য বৃদ্ধি করতে হবে।
এই ব্লগের মাধ্যমে আমি ইতিহাসের অপলাপচর্চার (সত্যকে এড়িয়ে অন্যভাবে উপস্থাপন) বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ঘোষণা করছি। কারণ সত্য গোপন করলেই ইতিহাস মুছে যায় না; বরং তা ভবিষ্যতের জন্য আরও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে।
আব্দুর রশিদ সরকারের মতো অমর নেতার রক্ত বৃথা যেতে পারে না। তাঁর ত্যাগ, তাঁর নেতৃত্ব, এবং তাঁর অনপেক্ষাকারী মনোবৃত্তি আমাদের চেতনায় অম্লান থাকুক। হোক এই ব্লগ একটি দুঃখস্নাত জলধারা—যা প্রবাহিত হবে শত সহস্র বাঙালির হৃদয়ে, চেতনায় ও সংগ্রামে।