উজ্জ্বলেন্দু চাকমা
আজ শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা, ২৫৬৯ বুদ্ধাব্দ। রোজ বুধবার। তাই সকলকে শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাই। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন সরকারি ছুটি রয়েছে এজন্য সদাশয় সরকারকে অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
মহাকারুণিক ভগবান তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ তার এই ধর্মের সর্বোত্তম বাণী হলো:
“সব্ব পাপস্সা অকরণং কুসালস্স উপসম্পদা সচিত্তা পরিয়োদপনং এতং বুদ্ধানসাসনং”
ধম্মপদ- ১৮৩
অর্থাৎ, সকল প্রকার পাপকর্ম না করা, কুশল বা পূণ্য কর্ম সম্পাদন করা এবং নিজ নিজ চিত্ত সুন্দর বা পরিশুদ্ধ করা-এ সবই হল বুদ্ধগণের অনুশাসন। এটাই হলো মহকারণিক ভগবারন বুদ্ধের সর্বজীবের প্রতি অহিংসার মৈত্রীভাব।
এ মহান পবিত্র “বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধ পূর্ণিমা” বৌদ্ধ বিশ্বেও একটি অন্যান্য ধর্মোসৎসবের দিন। বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধ পূর্ণিমা বিশ্বের বৌদ্ধ সমাজে এক মহান পবিত্রতম দিন। ভগবান তথগত বুদ্ধ তার জীবন ইতিহাসের এক অভিস্বরণীয় তিনটি ঘটনাবলি তথা ত্রি-স্মৃতি বিজরিত জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ, এবং মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্ত এই তিনটি ঘটনাকেই নিয়ে বৈশাখী পূর্ণিমা। বৌদ্ধ সমাজে তথা বিশ্বের প্রধান দেশে এই দিনটি-কে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ সহকারে উদযাপন করে আসছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রধান দেশে বৈশাখী পূর্ণিমাকে Vesak Day হিসেবে ও অবিহিত করে। শুভ বৈশাখী পূর্ণিমায় তৎকালীন ভারতবর্ষের কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে শালবৃক্ষের তলায় রাজ কুমার সিদ্ধার্থের জন্ম। তখনি সিদ্ধার্থ ভূমিষ্ট হওয়ার পরপরই সপ্তপদ হেঁটে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন “জেট্ ঠোহস্মিং সেট্ ঠোহস্মিং অয়মস্তিমা জাতিং” অর্থাৎ আমিই জোষ্ট, আমিই শ্রেষ্ট, এবং এতাই আমার অন্তিম জন্ম। এছাড়াও এ ঐতিহাসিক বর্ষে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে রাজ কুমার সিদ্ধার্থের জন্মসহ একই সাথে তথগত বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দ, সান্ত্রী কালুদায়ী, সহধর্মীনি যশোধরা, সারথী চন্দক, বেগবান অশ্ব কন্ঠক, চারিনিধিকুম্ভ, বৌধিজ্ঞান লাভের মহাবোধি বৃক্ষ ভূমিষ্ট হন তারপর মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ এবং মহপরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন। তাই বিশ্বের বৌদ্ধ সমাজে বৈশাখী পূর্ণিমার গুরুত্ব ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। ঋতুর মধ্যে প্রধান হলো বসন্ত, তাই বসন্তকে ঋতুরাজ বলে থাকে। তিথির মধ্যে ও পূর্ণিমা শ্রেষ্ট। মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধ এই বৈশাখী পূর্ণিমার তিথিইে তাঁর জন্ম-বুদ্ধত্বলাভ-মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। সেই বৈশাখী পূর্ণিমায় ভগবান তথাগত বুদ্ধের ত্রি-স্মৃতি বিজরিত ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। যা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোন স্থানে নজির নেই যে কোন মহাপুরুষের এক তিথিতে তিনটি ঘটনার কথা।
এখানে ‘বুদ্ধ’ ও ‘বৌদ্ধ’ শব্দে দ্বারা অনেকেই একই মনে করে থাকেন। বুদ্ধ বলতে জ্ঞান চক্ষু, জ্ঞানলোকে, প্রাজ্ঞ, প্রবুদ্ধ, সম্বুদ্ধ, পরমাজ্ঞান, জ্ঞানী অর্থে বুঝায়। বৌদ্ধ অর্থে সাধারণত বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরকে বলা হয় বৌদ্ধ। বুদ্ধ নির্দেশিত বিনয়নীতির উপর ধর্ম অনুসরণ করে তার জ্ঞান সাধনায় রত থেকে অণুকরণ, অনুশীলন এবং অনুধাবন করে যাঁরা আচরণ করেন তারাই হলেন বৌদ্ধ। জন্ম সূত্রে বৌদ্ধ হয় না, কর্ম সূত্রেই বৌদ্ধ। বৌদ্ধ একটি সমষ্টি বাচক শব্দ এই শব্দ দ্বারা একটি পরিবার, সমাজ, সম্প্রদায়, জাতি বুঝায়। কিন্তু বৌদ্ধ জাতিগত অর্থে নয় জ্ঞান আহরণ অর্থে বুঝায়। বৈশাখী পূর্নিমার বৌদ্ধ সমাজে কত বড় তাৎপর্যময় তা বোঝাবার নয়। ভগবান তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ তার অন্তিম কালে বলেছিলেন “হন্দদানি ভিখকবে আমন্তযামি বো, বয়ধম্ম সঙ্গারা অল্পমাদেনা সম্পাদেথা” অর্থাৎ “হে ভিক্ষুগণ, তোমাদের পুনঃ বলছি, সংস্কার ধর্ম সমূহ একান্ত ক্ষয়শীল, তোমরা অপ্রমত্ত হয়ে স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন কর”। এতাই বুদ্ধের অন্তিম বাণী। এই মহান পবিত্র দিন ব্যাপি দান, ধর্মালোচনা, শীল আচরণ ও ধ্যান সাধনায় রত থেকে বৌদ্ধ নরনারীর একাগ্রচিত্তে সম্পাদন করে থাকেন। এই দিনে যে যার মত সামর্থ্য অনুসারে ‘উপোসথ’ পালন করে থাকে। বৌদ্ধদের ভাষায় হলো ‘উপোসথ’, খ্রীস্টানদের হলো ‘ফাস্টিং’, হিন্দুদের হলো ‘উপবাস’ আর মুসলিমদের হলো ‘রোজা বা সিয়াম’। পরিশেষে দেশের এবং বিশ্বের সকলপ্রাণীর হিতসুখ ও মঙ্গলার্থে প্রার্থনা করি সকলেই সুখে অবস্থানে বসবাস করেন। দেশের এবং বিশ্বের অস্থিতিশীল পরিবেশ শান্তিতে বর্ষিত হোক সদা সর্বদা।
বর্তমান বিশ্বের মধ্যে যে হানাহানি-মারামারি, অস্ত্রের ঝনঝনানি হচ্ছে এবং সেগুলি জীবের সৃষ্টি সেরা জীব মানুষ দ্বারা সম্পাদন করা হচ্ছে। সেই জন্য এখনই মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধের নীতি অনুসরণ-অনুকরণ এবং অনুশীলনের অতীব প্রয়োজন হয়েছে। তথাগত বুদ্ধ এই ৫টি বাণিজ্য বা ব্যবসা না করার নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন- (১) অস্ত্র ব্যবসা- সারা বিশ্বের অস্ত্রের ঝনঝনানি চলার কারণে আজ বিশ্ব অশান্তির বিরাজমান চলছে, (২) প্রাণী ব্যবসা- সারা বিশ্বের মানব পাচার (বিশেষ করে নারী পাচার) চলমান থাকায় অশান্তির অন্যতম কারণ, (৩) নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবসা- আগামী প্রজন্ম তথা উদীয়মান যুব সমাজ আজ অনেকটা নেশাগ্রস্থ হওয়ার কারণে সমাজ অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে, (৪) বিষ ব্যবসা-বিষের দ্বারা যেকোন প্রাণীর প্রাণঘাটি হয়ে থাকে, (৫) মাংস ব্যবসা-মাংস ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রাণী হত্যা না করার দিকটি বুঝিয়েছেন। এ পাঁচটি বাণিজ্য পরিহার করে সম্যক (সম্যক জীবিকা মানে সঠিক জীবিকা) জীবিকা করার জন্য তথাগত বুদ্ধ তাঁর দেশনায় উপদেশ দিয়েছেন। তাই আসুন বুদ্ধের শিক্ষা অনুসরণ-অনুকরণ এবং অনুশীলনের দ্বারা আজ থেকে শপথ নিই এই ৫ প্রকার ব্যবসা বা পঞ্চ বাণিজ্য করবো না। তাহলেই না আমাদের সম্যক জীবিকা নির্বাহ হবে। তবেই ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার-সমাজ-দেশ এবং বিশ্বে শান্তির সুবাতাস অনুকূল এবং প্রতিকূল প্রসারিত হবে।
ভবতু সব্বা মঙ্গলং- জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক, নিরাপদে থাকুক সবসময়।
লেখক: উজ্জ্বলেন্দু চাকমা
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)
আগারগাঁও, ঢাকা।