পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ ও অবদান: এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

0
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা কার্যক্রম

হান্নান সরকার 

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অঙ্গভূত অংশ হলেও একটি সময় পর্যন্ত এই জনপদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংযুক্তি ছিল সুদূরপরাহত। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এই ভূখণ্ডে স্বাভাবিক শাসন প্রক্রিয়া চালু রাখা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে যে প্রতিষ্ঠানের অনন্য ভূমিকা রয়েছে, তাহলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এই বাহিনীর আত্মত্যাগ, কষ্টসাধ্য পরিশ্রম এবং সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন পরিকল্পনা আজ পাহাড়ের দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে।

১৯৭২ সালে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) গঠিত হওয়ার পরপরই ১৯৭৩ সালে তারা শান্তিবাহিনী নামক একটি সশস্ত্র শাখা গঠন করে এবং ৫ দফা দাবিতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৯৭৫ সালে খিরামবন বিভাগে হামলা, জুরাছড়ি পুলিশ ক্যাম্পে হামলা, ১৯৭৭ সালে সাঙ্গু নদীতে টহলরত সেনাসদস্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কাদেরসহ পাঁচজন সেনাসদস্যকে হত্যা এবং বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন ও নিরস্ত্র জনগণের উপর হামলার মাধ্যমে শান্তিবাহিনী পাহাড়ে এক বিপজ্জনক অরাজকতার সূচনা করে।

পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঠেকাতে রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা মোতায়েন করে এবং ধাপে ধাপে সেনা সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে। পাহাড়ের দুর্গম, বিষাক্ত ম্যালেরিয়াপ্রবণ ও জনবিচ্ছিন্ন অঞ্চলসমূহে দায়িত্ব পালন করা সেনাবাহিনীর জন্য ছিল এক অক্লিষ্টকর্মার নজির। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তাদের নিত্য যাপন, দুর্গম পথে টহল, অভিযানে অংশগ্রহণ এবং নিরস্ত্র বাঙালিদের জীবনরক্ষা ছিল এক অসামান্য দৃষ্টান্ত।

১৯৭৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পুনর্বাসনের কার্যক্রম শুরু করে সরকার, যার ফলে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। এই পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে শান্তিবাহিনী আরও আগ্রাসী হয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর আক্রমণ ও হত্যা চালায়। ফলে পাহাড়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি হয়ে ওঠে অপরিহার্য। একদিকে জনগণের নিরাপত্তা, অন্যদিকে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখা ছিল একসাথে ভারসাম্যপূর্ণভাবে পরিচালনার চরম দায়িত্ব।

সেনাবাহিনীর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল রাষ্ট্র রক্ষার দৃঢ় সংকল্পের প্রতিফলন। পাহাড়ের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকা ছিল যে কতটা চ্যালেঞ্জিং, তা স্পষ্ট হয় পুর্নবাসিত প্রবীণ বাঙালিদের কথায়। তারা মনে করেন, শান্তিবাহিনীর তীব্র গেরিলা আক্রমণ, ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব, খাদ্য-ওষুধের সংকট, দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থার মধ্যে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালন ছিল এক মহাকাব্যিক সংগ্রাম।

পাহাড়ে সভ্যতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা বিস্তার, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থানমুখী কার্যক্রম—এ সমস্ত কিছুই সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ও কর্মদক্ষতার ফসল। পাহাড়ের খাড়া ঢালুতে রাস্তাঘাট নির্মাণ, দুঃসাধ্য স্থানে ব্রিজ-কালভার্ট স্থাপন, দূরদূরান্তে স্কুল-কলেজ স্থাপন, অসুস্থদের চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেয়া, মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপন ইত্যাদি সকল কর্মযজ্ঞে সেনাবাহিনীর অবদান অবিস্মরণীয়।

৭২০ জনের অধিক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য শহীদ হয়েছেন পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে। আহত হয়েছেন অগণন সেনা সদস্য। এক একজন শহীদের রক্তে আজ পাহাড়ে গড়ে উঠেছে উন্নয়নের ভিত্তি। আজকে নাইক্ষ্যংছড়ি, বাঘাইছড়ি ও পানছড়ির মত দুর্গম অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষও ভোগ করছে শিক্ষা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ এবং উন্নত জীবনধারা। ১৯৭৯ ও ১৯৯৭ সালের পূর্বে এসব এলাকায় প্রায় আদিম জীবনযাপন চললেও, আজ সেখানে আলো জ্বলেছে, শিশুদের হাতে বই উঠেছে, প্রসূতিদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছেছে।

সেনাবাহিনীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ পর্যটনের নতুন স্বপ্নলোক। সাজেক, নীলগিরি, আলুটিলা, বগালেক, থানচি—এই স্থানগুলোতে আজ হাজার হাজার পর্যটকের আগমন, স্থানীয়দের আয়ের উৎস এবং রাষ্ট্রের সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। অথচ এই অঞ্চলগুলো ছিল কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দুর্গ, যেখানে প্রবেশ করাটাও ছিল জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ। এই পরিবর্তনের পেছনে সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য।

তবে দুঃখজনকভাবে, এক শ্রেণির সুশীল সমাজ, বাম রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং তথাকথিত মানবাধিকারকর্মী সবসময়ই সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। তাদের চোখে পাহাড়ে সেনা শাসনের সমালোচনা থাকলেও, সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন নিয়ে তারা নিশ্চুপ থাকে। এই নিঃস্তব্ধতা যেন একপাক্ষিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।

পাহাড়ে পুনর্বাসিত বাঙালি এবং সাধারণ উপজাতি জাতিসত্তা বিশ্বাস করেন, সেনাবাহিনী না থাকলে এই পাহাড় অরক্ষিত হয়ে পড়বে, এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে। আজ সেনাবাহিনীর পদচারণ যেখানে পৌঁছেছে, সেখানেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। পাহাড়ের আনাচে-কানাচে নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রমই নিশ্চিত করেছে রাষ্ট্রের একত্ববোধ। কিন্তু সময়ের সাথে সাথেই পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহার অঞ্চলটির দুর্গম এলাকায় নিরাপত্তা সংকট তৈরি হয়েছে।

এই পার্বত্য জনপদে সেনাবাহিনীর অতীত দিনগুলো ছিল অগ্নিদ সময়। অস্ত্র হাতে নয়, তারা এক হাতে অস্ত্র, অন্য হাতে উন্নয়নের বার্তা নিয়ে পাহাড়ে এসেছে। এই বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি—অস্ত্রের মাধ্যমে নিরাপত্তা ও উন্নয়নের মাধ্যমে মন জয়—ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

সেনাবাহিনী শুধু একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী নয়, বরং আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের কারিগর। অন্ধকারে ডুবে থাকা অঞ্চলে তারা এনেছে আলো, নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকা মানুষকে ফিরিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রের সান্নিধ্য। সেনাবাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ে শুধু চাকরি করেননি, বরং সেখানে তারা জীবন রেখে গেছেন, ভবিষ্যৎ রেখে গেছেন। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরও সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, এখানকার মানুষদের নিরাপত্তা এবং শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী ভূমিকা রাখছে।

এই অবদান আমাদের নতুন প্রজন্মের জানা উচিত। ইতিহাসে তাদের আত্মত্যাগ লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত। যারা আজ সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি তুলেন, তারা যেন জানেন, এই ক্যাম্পই একদিন তাদের সন্তানকে পড়াশোনার সুযোগ দিয়েছে, অসুস্থ মাকে চিকিৎসা দিয়েছে, দুর্গম পাহাড়ে খাদ্য পৌঁছে দিয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনী নিয়ে কথিত ‘সেনাশাসন’ শব্দটি এক প্রকার অপপ্রচার। সেনাবাহিনী কখনোই দমনমূলক আচরণ করেনি, বরং তারা পাহাড়ের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। এই সম্পর্ক, এই আত্মত্যাগ, এই উন্নয়নের ইতিহাস যেন চিরকাল অম্লান থাকে।

শেষত, রাষ্ট্রের উচিত এই সাহসী পুরুষদের, শহীদ সেনা সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানানো, তাদের পরিবারকে পুনর্বাসন ও ভাতা প্রদান এবং সেনাবাহিনীর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরা। যেন কেউ আর অপপ্রচারের ধোঁয়াশায় বিভ্রান্ত না হয়।

আগের পোস্টআনাই মগিনীকে চাকরি দিলেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা।
পরের পোস্টসন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণে কাঁপলো সরই — পুলিশ ফাঁড়ি ঘিরে হুমকি, আতঙ্কে জনপদ।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন