স্টাফ রিপোর্টার, হিলনিউজবিডি.কম
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী চরম্বা নাফারটিলা এলাকায় গত বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫ পরন্ত বিকেলে ফের দেখা মিলেছে সশস্ত্র টহলের। স্থানীয়দের আতঙ্ক আর অভিযোগের কেন্দ্রে এবারও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র সদস্যরা। ওই দিন বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে অন্তত ২২ জনের একটি দল সেগুনবাগানের ভিতরে প্রবেশ করে সশস্ত্র মহড়া দেয় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
স্থানীয় যুবক শহীদুল ইসলাম জুয়েল ও তার এক সঙ্গী ওই সময় নাফারটিলা পাহাড়ে ঘুরতে গেলে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা তাদের ধরে ফেলে, কোথা থেকে এসেছে জিজ্ঞাসাবাদ করে, ভয়ভীতি দেখায় এবং মুখ বন্ধ রাখতে বলে ছেড়ে দেয়। এই ঘটনায় নতুন করে চরম্বা ও পার্শ্ববর্তী বান্দরবানের লামা উপজেলার জনপদে ভীতির সঞ্চার হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী শুধু সশস্ত্র মহড়া দিয়েই থেমে থাকছে না, বরং প্রতিনিয়ত ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করছে। চরম্বা নাফারটিলা বাজার, রাজঘাটা ব্রিকফিল্ড, কলাউজান গাবতলী, এমনকি টংকাবতী ব্রিকফিল্ড এলাকাও এখন চাঁদাবাজদের নিয়মিত লক্ষ্যবস্তু।
স্থানীয়রা জানান, গত ৬ মার্চ ২০২৫ খ্রি. রাত সাড়ে ৮টার দিকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় চাঁদা না দেওয়ায় তিন ইটভাটায় সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে জেএসএস সন্ত্রাসীরা। এ সময় ইটভাটার মালিক ও ম্যানেজারদের না পেয়ে ২০ জনের অধিক শ্রমিককে মারধর করে পালিয়ে যায় তারা। লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা নোয়ারবিলা রাজঘাটা বান্দরবান সীমান্ত এলাকায় আইবিএম, এনবিকে ও এনবিএম ইটভাটায় এ ঘটনাটি ঘটে। আহতদের চিকিৎসা ব্যয়ে প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয়। এরপরও প্রায় মাসখানেক আগে চাঁদা দিয়েও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা মেলেনি; আবারও চাঁদা চাওয়া হয় এবং না দিলে হুমকি প্রদান করা হয়।
পাহাড়ে শান্তি নয়, আতঙ্কের নাম শান্তিবাহিনী—
স্থানীয় বাসিন্দা নেজাম উদ্দিন, জিয়া উদ্দিন, আব্দুল মালেক, মো. আবু হানিফ হিরো, আব্দুল আলম ও মিজানুর রহমান বলেন, “প্রতিনিয়ত শান্তিবাহিনীর সদস্যরা এসে বাজারে, ব্রিকফিল্ডে কিংবা দোকানে গিয়ে চাঁদা দাবি করে। কেউ দিতে না চাইলে ভয়ভীতি ও মারধর করে।” তাদের দাবি, সীমান্তবর্তী এই এলাকায় প্রশাসনের কার্যকর উপস্থিতির অভাবেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তারা বলেন, “এই অঞ্চল চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী হওয়ায় প্রশাসনের একপেশে দৃষ্টি এখানে নেই বললেই চলে। অথচ এই এলাকাগুলোও বাংলাদেশেরই অংশ।”
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের কেয়াজুপাড়া বাজারে ১৭ মে রাত ৯টা ৪০ মিনিটে একটি উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটে। অভিযোগ অনুযায়ী, শান্তিবাহিনীর একদল সশস্ত্র সদস্য হঠাৎ বাজারে প্রবেশ করে দুই রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে, ব্যবসায়ীদের মারধর করে এবং পুলিশ ক্যাম্প ঘেরাও করে রাখে। আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো, ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা পুরো ঘটনার সময় নিরব ভূমিকা পালন করেন। পরে সশস্ত্র সদস্যরা স্থানীয়দের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে এবং নির্ধারিত সময়ে তা পৌঁছে দেওয়ার হুমকি দিয়ে স্থান ত্যাগ করে।
স্থানীয় জানায়, সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, এই বাজারটির মাত্র ২০ গজ দূরেই পুলিশের ক্যাম্প এবং দুই কিলোমিটার দূরত্বে সেনা ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রতিরোধ দেখা যায়নি।
সচেতন সমাজের প্রতিনিধি, মহিবুল্লাহ চৌধুরী ১৯ মে এক ফেসবুক পোস্ট দিয়ে বলেন,”শিয়াল কুকুরের মতো ১২ বছর বাঁচার চেয়ে সিংহের মতো মাথা তুলে একদিন বাঁচার চেষ্টা করো।
বান্দরবানের লামা উপজেলাধীন, সরই ইউনিয়নের কেয়াজুপাড়া বাজারে, গত ১৭/০৫/২০২৫ ইং রাত ৯টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ১০ ঘটিকা পর্যন্ত পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী জেএসএস কর্তৃক সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের উপর যে অত্যাচার করা হয়েছে তা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই। সরই পুলিশ ক্যাম্প থেকে ১০০ গজের মধ্যে ঘটনা হলেও পুলিশ নিরব দর্শকের ভূমিকায় ঘুমিয়ে ছিলেন কেন..?? লামার কোন সাংবাদিক একটা পোস্ট পর্যন্ত করেনি!! তাহলে সাংবাদিকতায়ও দালালি ঢুকে গেছে..?? না জেএসএসের ভয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে..?? গজালিয়া আর্মি ক্যাম্পে মোবাইল করে জানানো হলেও তাদের কোন সহযোগিতা পায়নি নিরীহ মানুষ গুলো। বান্দরবানের পুলিশ সুপার ও বান্দরবান ব্রিগেড কতটুকু ব্যবস্থা নিবে সেটা এখন দেখার বিষয়। জননিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে সেখানে প্রশাসন প্রয়োজন নেই।”
সাংবাদিকতা ও প্রশাসনের দায় এড়ানো প্রশ্নবিদ্ধ: এই ঘটনার পর ক্যায়াজুপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জানান, “মামলার স্বাক্ষীর কাজে আমি বাহিরে রয়েছি। জেনেছি, একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাজার হয়ে কোনো একদিকে যাচ্ছিল, ওই সময় বাজার ব্যাবসায়ী আবুল কালাম সওদাগরকে মারধর করেন।”
অপরদিকে স্থানীয়রা বলেন, “শুনেছি পুলিশ ঘটনাস্থল ছেড়ে পালিয়ে গেছে।”
স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল আলম বলেন, “প্রতিদিন শান্তিবাহিনীর লোকজন এসে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়। প্রশাসন নিরব দর্শক। এভাবে চলতে থাকলে আমরা আত্মরক্ষার পথ খুঁজতে বাধ্য হবো।”
‘চাঁদা না দিলে মেরে ফেলার হুমকি’
স্থানীয় আবুল মালেক তাই জানান, “চরম্বা নাফারটিলা বাজারে একজন বয়স্ক লোক বললেন, শান্তিবাহিনী প্রতিদিন এসে টাকা নেয়। কেউ দিতে না চাইলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এটাই এখন বাস্তবতা।”
মিনহাজ নামের তরুণ বলেন, “বাজারের পাশেই পুলিশ ক্যাম্প, তবুও কিছু হচ্ছে না। পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও সাহস বা আন্তরিকতা নেই।” এই প্রশ্নের উত্তরে আবুল হাসেম বলেন, “শুনেছি, পুলিশ নিজেরাই ভয়ে পালিয়ে গেছে।”
প্রশ্ন জনসচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, “বান্দরবানের পুলিশ সুপার, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক স্তরগুলো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে।”
সচেতন নাগরিকদের মতে, “শান্তিবাহিনীর নামে পাহাড়ি এলাকায় যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদিচ্ছার অভাবেই সম্ভব হচ্ছে। প্রশাসন যদি জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়বে।”
তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ে জেএসএস ছাড়াও বিভিন্ন পাহাড়ি সংগঠন থেকে দলছুট সন্ত্রাসীরা একজোট হয়ে আস্তানা গড়ে তুলেছে। তারা নিয়মিত সশস্ত্র টহল দিয়ে এলাকায় ভীতি সৃষ্টি করছে এবং ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, এমনকি খুনের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
চরম্বা-নাফারটিলা ও কেয়াজুপাড়ার মতো সীমান্তবর্তী এলাকায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবাধ চলাফেরা ও চাঁদাবাজির ঘটনাগুলো এখন পাহাড়ি জনপদের প্রতিদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, প্রশাসনের নিরবতা চলতে থাকলে এর বিস্তার আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
জনগণের একটাই প্রত্যাশা—পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে এবং চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস নির্মূলে প্রশাসনের সক্রিয় পদক্ষেপ জরুরি। নইলে পাহাড়ে শান্তির বদলে শুধু ভয় আর রক্তের গল্পই বাড়বে।