অনন্ত অসীম
ভালোবাসা কি কেবলই দুটি হৃদয়ের খেলা? নাকি সমাজ, জাতি, ধর্ম, সংস্কারের সীমারেখায় বাঁধা এক অনিশ্চিত অধ্যায়? যুগে যুগে প্রেম তার নিজস্ব পথ নির্মাণ করেছে বাধাবিপত্তির শিলাস্তরে। তেমনি এক ভালোবাসার কাহিনি রচনা করল জামালপুর সরিষাবাড়ি উপজেলার এক সাহসী বাঙালি যুবক রাশেদুল ইসলাম এবং রাঙামাটির বরকল উপজেলার পাহাড়ি তরুণী জয়ন্তি চাকমা, যিনি পরে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে হয়ে ওঠেন সিদরাতুল ইসলাম সাফা।
এই প্রেমকাহিনির সূচনা ঢাকার আশুলিয়ার ইপিজেড অঞ্চলের বিশ্বখ্যাত YKK গার্মেন্টসে। কর্মজীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে দু’জন হৃদয়ের মিলনে গড়ে ওঠে এক অদ্ভুত সম্পর্ক, যা সময়ের সাথে গাঢ় হতে থাকে। জাত-ধর্মের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে পাহাড়ি জয়ন্তি ও বাঙালি যুবকের এই প্রেম সমাজের প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে এক স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।

জামালপুরের সেই কালজয়ী গান— “আমি জামালপুরের পোলা, দেড়শ টাকা তোলা, দেখলে তোরে এই অন্তরে লাগে প্রেমের দোলা”— যেন বাস্তব রূপ নেয় এই যুবকের জীবনে। দেড়শ টাকা তোলার ওই গান এখন আর কেবল একটি ছায়াছবির গীতিকাব্য নয়, বরং হয়ে উঠেছে বাস্তবতার এক প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু সমাজ কি এত সহজে মেনে নেয় এমন সাহসী ভালোবাসার গল্প?
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রেম সম্পর্ককে ভাঙতে আশুলিয়ার পাহাড়ি শ্রমিক ও তাদের সংগঠনগুলো নানা রকম চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। কখনো ধর্মীয় মূল্যবোধের নামে, কখনো জাতিগত অস্তিত্বের হুমকির অজুহাতে, তারা এই সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়। এমনকি তরুণীর মা-কে পাহাড় থেকে ডেকে এনে আশুলিয়া থানার মাধ্যমে উদ্ধার অভিযান পরিচালিত হয়।

কিন্তু প্রেম তো সহজে হার মানে না। আশুলিয়া থানার সহযোগিতায় জামালপুরের পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও জয়ন্তি স্পষ্ট জানিয়ে দেন—তিনি তার মায়ের সঙ্গে যেতে চান না। একপর্যায়ে তার মা আত্মহত্যার হুমকি দিলেও, জয়ন্তি তার ভালোবাসাকে রক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলেন সকল আত্মত্যাগে। এমনকি মায়ের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্তও নেন।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি উগ্র উপজাতি অংশ মেয়েটিকে দোষারোপ করে, ভালোবাসার এই জয়কে প্রতিহত করতে হুমকি-ধমকি দিয়ে উঠে পড়ে লাগে। “বাঙালি যুবককে বিয়ে করলে এর পরিণাম ভোগ করতে হবে”—এই বার্তা যেন সামাজিক সহিংসতার স্পষ্ট পূর্বাভাস।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতায়, এক পাহাড়ি তরুণীর স্বাধীন প্রেম ও বিবাহের অধিকার আজও রুদ্ধ। পাহাড়ি নারীরা যখন বাঙালি ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে, সম্পর্ক গড়ে, বা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন তাদের উপর নেমে আসে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর নৃশংসতা। অতীতে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে পাহাড়ি নারীকে ধর্ষণপূর্বক হত্যা করা হয়েছে, কখনো “নিলামে” তোলা হয়েছে, আবার পরিবারকে সমাজচ্যুত করে মোটা অংকের জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
তবুও পাহাড়ি তরুণীদের একটি অংশ সাহস করে বেরিয়ে আসে। কারণ, তাদের একাংশের মতে পাহাড়ি পুরুষদের অনেকে জড়িয়ে পড়ে মদ-গাঁজা-মাদক, জুয়া ও নারাসক্তির মতো অন্ধকারে। তারা সংসার জীবনে দায়িত্বহীন, নিরুদ্দেশ এবং সহিংস। সেই তুলনায় অনেক বাঙালি যুবককে তারা দেখে পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল এবং ভালোবাসায় সজীব।
সেই ভালোবাসার শক্তি থেকেই জয়ন্তি চাকমা ত্যাগ করেন তার বৌদ্ধ ধর্ম ও পূর্বপরিচয়, বেছে নেন নতুন জীবন, নতুন ধর্ম, নতুন পরিচয়—সিদরাতুল ইসলাম সাফা। তার পাশে আছেন তার স্বপ্নের জামালপুরের যুবক। পাহাড়ের রুক্ষ বাস্তবতা থেকে উঠে এসে এই তরুণী আজ জীবন গড়েছেন সমতলের আলোকিত পথে।
এ যেন এক চিরায়ত ভালোবাসার জয়গাথা—যেখানে ধর্ম, জাতি, সমাজব্যবস্থার গণ্ডি ছিঁড়ে ভালোবাসা তার নিজস্ব ঠিকানা খুঁজে নেয়। এই প্রেম কেবল দুটি হৃদয়ের মিলন নয়, এটি একটি প্রতিবাদ, একটি বিদ্রোহ, একটি নিঃশব্দ বিপ্লব—যা প্রেমকে ঈশ্বরতুল্য করে তোলে।
ভালোবাসা জাত-ধর্ম মানে না, সেটি শুধুই একটি প্রচলিত বাণী নয়— পাহাড়ি তরুণী জয়ন্তি ও বাঙালি যুবকের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সে কথার প্রমাণ। পাহাড়ের ঘন অন্ধকারকে পেছনে ফেলে সমতলের আলোয় যারা হাতে হাত রেখে হাঁটে, তাদের জয় অনিবার্য।