নিজস্ব প্রতিবেদক
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমার ‘বিশেষ স্বায়ত্তশাসন অঞ্চল’ গঠনের গভীর ষড়যন্ত্র, এবং সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তিকে ঘিরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার কণ্ঠে যে ভয়ঙ্কর সত্য উন্মোচিত হয়েছে, তা গোটা জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
ভিডিও-
২৪ মে, ২০২৫ খ্রি. ঢাকার মহাখালীস্থ সেনা কল্যাণ ভবনের এসকেএস টাওয়ারে সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত “UPDF এর নেতা মাইকেল চাকমা কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসন অঞ্চল গঠনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যা সমাধানের উপায়” শীর্ষক মতবিনিময় সভায় অতিথির আসনে বক্তব্য রাখেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) এস এম মতিউর রহমান, এএফডব্লিউসি, পিএসসি।
লে. কর্নেল ফরিদুল আকবরের সভাপতিত্বে এবং মোস্তফা আল ইহযাযের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় তিনি বিস্ফোরক মন্তব্য করে বলেন— “প্রকৃত পক্ষে শান্তিচুক্তির কোনো ভিত্তি নেই। ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর যে চুক্তি হয়েছিল, সেটিকে আদৌ চুক্তি বলা যায় কিনা? সেখানে ব্যাপক সন্দেহ আছে। ৯৭’র শান্তিচুক্তির স্বাক্ষরিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে, তা বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ সন্তু লারমার জ্ঞাতি ভাই ইউপিডিএফ নাম ধারণ করে ১৯৯৮ সালে নতুন করে আবার সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। আর তাছাড়া শান্তিচুক্তির অন্যতম শর্ত যেটি, তা পালন করা হয়নাই। শান্তিচুক্তির প্রধান শর্ত ছিল অস্ত্র আত্মসমর্পণ করা—কিন্তু সন্তু লারমা আইওয়াস কিছু ভাঙা, মরিচা ধরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণের নাটক করে। প্রকৃত পক্ষে তারা তাদের ভালো ভালো নামি-দামি অস্ত্রগুলো বিভিন্ন জায়গাতে বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রেখেছিল। যেগুলো এখন সশস্ত্র আন্দোলনে ব্যবহার করছে।”
এ সময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অবদান বিশেষ করে পাহাড়ি জনগণের চিকিৎসা সেবায় তাদের অগ্রণী ভূমিকা, ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করে সেনাবাহিনী পাহাড়ে কাজ করা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অধিকার, বঞ্চনা ও দাবিদাওয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
এই বক্তব্যে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে এক ভয়ঙ্কর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
স্মরণযোগ্য, এস এম মতিউর রহমান জুয়েল ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিন তারকাবিশিষ্ট একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তিনি ময়মনসিংহ সেনানিবাসে জিওসি এআরটিডিওসি, পরবর্তীতে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং সর্বশেষ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই মতবিনিময় সভায় তাঁর মতো একজন প্রাজ্ঞ সামরিক কণ্ঠের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ কোনোভাবেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
পার্বত্য চুক্তি নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ— পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরবর্তী সময় থেকেই আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা ঘিরে ইউপিডিএফ ও জেএসএস পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। এই অন্তর্ঘাতমূলক সংঘাতের করুণ বলি হচ্ছেন সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণ। গত দুই যুগের অধিককাল ধরে চলমান এ সংঘাত পাহাড়ের শান্তি-শৃঙ্খলা ভেঙে দিয়েছে, জনমনে সৃষ্টি করেছে এক অনিবার্য অস্থিরতা ও আতঙ্ক। দিনদিন পাহাড়ে বাড়ছে অবৈধ অস্ত্র ৷ ফলে বেড়ে চলেছে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুম এবং রাস্ট্রবিরোধী তৎপরতা।
চুক্তি নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়:
চুক্তিতে বিদ্যমান বৈষম্য নিয়ে আপত্তি রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অপেক্ষাকৃত স্বল্পসংখ্যক জাতিসত্তাসমূহ—যেমন বম, লুসাই, খিয়াং, মুরং, ম্রো ও পাংখোয়ার—মধ্যেও। তাঁদের অভিযোগ, এই চুক্তিতে একক জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হলেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর স্বাতন্ত্র্য, ন্যায্য অধিকার ও অংশগ্রহণ উপেক্ষিত থেকেছে চরমভাবে।
অপরদিকে, চুক্তির বিভিন্ন সংবিধানবিরোধী ধারা ও উপধারাকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও গভীর আপত্তির জন্ম নিয়েছে। তাঁদের বিশ্বাস—এই চুক্তিতে উপজাতীয়দের একচেটিয়া আধিপত্য স্বীকৃতি পেয়েছে, পক্ষান্তরে বাঙালিদের করা হয়েছে বঞ্চিত। পাহাড়ের বাঙালিরা শিক্ষা, চাকরি, কর্মসংস্থান থেকে পিছিয়ে। ফলে, চুক্তির পূর্ণাঙ্গ সংশোধন, সংবিধানগত সামঞ্জস্য বিধান এবং সমঅধিকারে বাঙালিদের অন্তর্ভুক্তির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন ও প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি সমাজ।
জেনারেল মতিউর রহমানের বক্তব্যে স্পষ্ট, পাহাড়ে এখনও সংগঠিত অস্ত্রধারী শক্তির উপস্থিতি রয়েছে, যারা গোপনে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে অস্ত্র সংগ্রহ করে যাচ্ছে। ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে সামনে রেখে সেখানে যে নতুন রক্তপাতের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তা এই বক্তব্যের পর আর আড়ালে থাকছে না।