অনন্ত অসীম
রাঙামাটির কাউখালী উপজেলা যেন বর্তমানে একটি ‘স্বায়ত্তশাসিত সন্ত্রাসী এলাকা’র রূপ নিয়েছে। এখানে কার্যত রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কোনো কর্তৃত্ব নেই, নেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃশ্যমান উপস্থিতি। এই শূন্যতাকে পুঁজি করে পার্বত্য চুক্তিবিরোধী সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) তাদের তৎপরতা দিনকে দিন ভয়াবহ রূপে সম্প্রসারিত করছে।
কাউখালীকে ইউপিডিএফ অনেক আগে থেকেই তাদের “স্ট্র্যাটেজিক বেইস” হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বিশেষত কুজইছড়ি মইনে পাড়া, টঙ্গীপাড়া, কোলাপাড়া, ডোবাকাটা, ঢলুপাড়া, পিত্তিপাড়া, হারাঙ্গী রিফিউজিপাড়া, লেবারপাড়া, নোয়াআদম, যৌথখামার, ম্যাতিঙ্গাছড়ি – এসব পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় এই সংগঠনের অস্ত্রধারী টহলদল ও চাঁদা কালেকশন ইউনিট অবাধে ঘুরে বেড়ায়। এ যেন এক ‘অঘোষিত স্বাধীন সন্ত্রাসী’, যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র নিরব ও নিষ্ক্রিয়।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, কুজইছড়ি, হারাঙ্গী রিফিউজিপাড়া, লেবারপাড়া— রংগো চাকমা ও উরদয় চাকমার দোকান বা রোগী মা দোকান পর্যন্ত, এসব জায়গায় প্রতিদিনই সশস্ত্র ইউপিডিএফ ও কালেকশন গ্রুপ জড়ো হয়ে আড্ডা দেওয়া, সাধারণ লোকজনকে জেরা করা এবং হাটের দিনে বাজারে বিক্রি করা ফলমূল থেকে চাঁদা আদায়ের দৃশ্য সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে।
সাপ্তাহিক হাটগুলো এখন চাঁদা আদায়ের উৎসবস্থল: হাটবারে যখন সাধারণ পাহাড়িরা কলা, কাঁঠাল, হলুদ, আদা কিংবা অন্যান্য ফসল বিক্রি করতে আসে, তখন তাদের পেরোতে হয় ইউপিডিএফ-এর ‘চাঁদা টোল গেট’। কোলাপাড়া, মাঝেরপাড়া, নোয়াআদম, উল্টোরাঙীপাড়া, বাদলছড়ি, বড়ঢুলু, বরইছড়ি – সর্বত্র একটাই দৃশ্যপট: চাঁদাবাজরা বসে থাকে দোকানের সামনে, আর নিরীহ জনসাধারণ বাধ্য হয়ে দিতে থাকে চাঁদার টাকা। অনেক সময় পণ্য বিক্রির পুরো টাকাটাই তারা দিয়ে আসে ইউপিডিএফের হিংস্র থাবায়।
চাঁদা কালেক্টরদের পরিচয় ও ক্ষমতার শিকড়:
ডিএস চাকমা, তারেক মারমা, অভি মারমা – এসব নাম এখন কাউখালীতে আতঙ্কের সমার্থক। এরা প্রকাশ্য দিবালোকে চাঁদা আদায় করে, ঠিকাদার, স্থানীয় ব্যবসায়ী, কৃষক, এমনকি দিনমজুর পর্যন্ত এদের হাত থেকে রেহাই পায় না। এ যেন এক চাঁদাবাজি-ভিত্তিক করব্যবস্থা, যেখানে অস্ত্রই একমাত্র কর্তৃত্বের উৎস। বিভিন্ন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও কাঠ ব্যবসায়ীরা চাঁদা ইউপিডিএফ ডেরায় পৌঁছে দিয়ে আসে এমনটা জনশ্রুতি আছে।
‘সহযোগী সংগঠনের’ নামে দুর্বৃত্তায়নের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: বর্তমানে ইউপিডিএফ শুধুমাত্র চাঁদাবাজিতে থেমে নেই; তারা কাউখালীতে নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করছে। কচুখালী, কলেজ রোড, হেডম্যান পাড়া – এসব জায়গায় গোপনে আসছে নতুন নতুন মুখ, যাদের বেশিরভাগই ইউপিডিএফ-এর সহযোগী সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), নারী সংগঠন এবং অন্যান্য কর্মী। তারা রাতের আঁধারে চিকা মারে, পোস্টার লাগায়, গুপ্ত বৈঠক করে। কৌশলে তারা পাহাড়িদের মধ্যে নতুন করে বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনী বিরোধী চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বাঙালিদের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল!
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, কাউখালীর কিছু কিছু এলাকা যেন বাঙালিদের জন্য ‘নিষিদ্ধ জোনে’ পরিণত হয়েছে। পিত্তিপাড়া, ঢুলুপাড়া, কোলাপাড়া, কুজইছড়ি, রিফিউজিপাড়া, লেবারপাড়া, নোয়াআদমে প্রবেশ করতে হলে চায় ‘চাঁদা টোকেন’। যার কাছে ইউপিডিএফ কর্তৃক প্রদত্ত অনুমতি বা চাঁদা প্রদানের প্রমাণ নেই, তার প্রবেশ নিষিদ্ধ। ঢুলুপাড়া, কোলাপাড়া, টঙ্গীপাড়া ও বরইছড়ির মতো জায়গায় বাঙালি জনগণের চলাচল একপ্রকার দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাব আছে এমন বাঙালি নেতা ইউপিডিএফ এর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তারা অবাধে যেতে পারেন৷ তাদের জন্য ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সুবিধা রয়েছে। তারা এখানকার বাঙালিদের জিম্মি এবং বিভাজিত করে রেখেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, “এখানে ব্যবসা করতে হলে ইউপিডিএফের অনুমতি লাগবে, নইলে অপহরণ কিংবা প্রাণহানির আশঙ্কাও থেকে যায়। এমন কী রাজনৈতিক পদ ক্যারি করতে ইউপিডিএফ এর আশীর্বাদ প্রয়োজন। ”
স্থানীয়রা জানান, কাউখালীতে ইউপিডিএফের এই দাপট ও আধিপত্য দেখে একটি প্রশ্ন বারবার সামনে আসে – রাষ্ট্র কোথায়? প্রশাসন কোথায়? কীভাবে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এতটা নির্মমভাবে নিজস্ব আইন ও নিয়ম চালাতে পারে? এখানে পাহাড়ের ভিতরে অঘোষিত শাসনভার চলে।
প্রশ্নটা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতার নয়, এটি নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বেরও ব্যর্থতা। সরকার যদি এইসব এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিদের নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানা গেছে, কাউখালীর সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে, লক্ষ্মীছড়ি, নানিয়াচর ও রাঙামাটি সদর উপজেলা৷ এই সীমান্ত এলাকায় ইউপিডিএফ এর বেশ কিছু ঘাঁটি রয়েছে৷ যেখানে অটোমেটিক রাইফেল – একে-৪৭, একে-৫৬, এম-১৬,
স্নাইপার রাইফেল – ড্রাগুনভ স্নাইপার রাইফেল, মেশিনগান – এমজি-৩, লাইট মেশিনগান (LMG), হ্যান্ড গ্রেনেড ও আইইডি – বিভিন্ন প্রকার বিস্ফোরক, রকেট লঞ্চার ও মর্টার – সীমিত পর্যায়ে থাকার সূত্র থেকে তথ্য পাওয়া গেছে এবং পিস্তল ও হ্যান্ডগান – অত্যাধুনিক গ্লক ও ব্রাউনিং সিরিজও।
এখানে পাহাড়ি জনসমর্থনকে ইউপিডিএফ নিজেদের কব্জায় নিয়েছে৷ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এখানকার পাহাড়িরা ইউপিডিএফ এর হাতের মুঠোয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ইউপিডিএফ কাউখালীতে চাঁদাবাজির যেমন আখড়া বানিয়েছে তেমনি সবকিছুতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাতা করতে সামর্থ হয়েছে।
গত ২০ মে ইউপিডিএফ চট্টগ্রামে যে পিসিপি’র তিন যুগ পূর্তির সমাবেশ করেছে, সেখানে কাউখালী থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক পাঠানো হয়েছে – এটিও এক ভয়ঙ্কর বার্তা বহন করে। এটি প্রমাণ করে যে কাউখালী এখন শুধু একটি সন্ত্রাসী চাঁদা সংগ্রহ কেন্দ্র নয়, বরং বাঙালি ও রাস্ট্র বিরোধী আন্দোলনের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রেও রূপান্তরিত হয়েছে।
কাউখালী এখন একটি বিস্ফোরক পরিস্থিতির মুখোমুখি। এখানে ইউপিডিএফের সশস্ত্র টহল, চাঁদাবাজি, জনজীবনে হস্তক্ষেপ, বাঙালি ভূমি বেদখল, বাঙালি দালালদের মাধ্যমে বাঙালি নাগরিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ – সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি পরিপূর্ণ দখলদার অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে খুব শীঘ্রই কাউখালী হবে পরবর্তী ‘নৈরাজ্যের রাজধানী’।
সরকার, প্রশাসনের উচিত এখনই জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে এই এলাকাকে ইউপিডিএফ প্রভাব মুক্ত করা। নতুবা পাহাড়ে সন্ত্রাস আবারো সেই ভয়াবহ দিনে ফিরবে, যখন কারো নিরাপত্তা ছিল না, কণ্ঠস্বর ছিল বন্দি, এবং রাষ্ট্র ছিল নির্বাক।