বান্দরবানে ধর্ষণের শিকার শিশু, নীরব জাতিগত পক্ষপাতের নির্মম প্রতিচ্ছবি।

0

বান্দরবানের কুহালং ইউনিয়নের বাকীছড়া বটতলী মারমা পাড়ার যে নির্মমতা আমাদের সকলের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তা নিছক কোনো অপরাধ নয়-এ এক জাতিগত পক্ষপাতের নির্মম উদাহরণ। ম্রো সম্প্রদায়ের এক শিশুকে ধর্ষণের যে নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে, তা শুধুমাত্র একজন নরপিশাচের বিকৃত মননের পরিচয় নয়, বরং পাহাড়ে বিরাজমান নীরব এক ষড়যন্ত্রের প্রতিচ্ছবি। অভিযুক্ত মেন ইয়া ম্রো (৪০) একই সম্প্রদায়ের মানুষ, আর তার হাতে নিপীড়নের শিকার এক নিষ্পাপ শিশু।

জানি, যদি এই ঘটনার পেছনে অভিযুক্ত হতেন কোনো বাঙালি যুবক, তাহলে আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে আগুন জ্বলত। জেএসএস, ইউপিডিএফ কিংবা তাদের সহযোদ্ধা সংগঠনগুলো রাস্তায় নেমে পড়ত বিক্ষোভে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ত ‘বাঙালি ধর্ষক’ হ্যাশট্যাগ। মানবাধিকার কর্মীদের বিবৃতি, সুশীল সমাজের কান্না, নারীবাদী নেতাদের সংবাদ সম্মেলন—সব একযোগে গর্জে উঠত। পাহাড়ে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর ওপর উঠত আঙুল। আবার বলা হত, ‘পাহাড়ে সেনাবাহিনীর মদদে উপজাতি নারীদের উপর বাঙালিদের নিপীড়ন চলছে।’

কিন্তু এবার? এবার যখন অভিযুক্ত মেন ইয়া ম্রো—একজন উপজাতি, তখন সেই সক্রিয় সুশীল সমাজের কণ্ঠ নিস্তব্ধ। কোথাও কোনো বিবৃতি নেই, প্রতিবাদ নেই, সংবাদ সম্মেলন নেই, জাতিসংঘে প্রেরিত অভিযোগপত্র নেই। যেন কিছুই ঘটেনি! এই দ্বিচারিতা শুধু ঘৃণ্যই নয়, তা অপরাধকেও উৎসাহ দেয়।

শিশুটির মা জানান, গত শনিবার রাতে দুই শিশুকে নিয়ে মেন ইয়া ম্রো (৪০) নামে এক ব্যক্তি সন্ধ্যায় ঝিড়িতে কাকড়া ধরতে যায়। ঝিড়িতে কাকড়া খুঁজতে খুঁজতে রাত বেশী হলে মেন ইয়া ম্রো বলে, ‘বাড়ী থেকে তো আমরা অনেক দূরে এসেছি, তাই আমরা আজ রাতে জুমের টংঘরে ঘুমিয়ে সকালে বাড়ীতে ফিরবো।’ সেই টংঘরে রাতে অবস্থান করার সময় মেন ইয়া ম্রো তার মেয়েকে ধর্ষণ করে। গভীর রাতে মেয়েটি চিৎকার করে বাড়ীতে রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরে আসলে শিশুটিকে রক্তাক্ত হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তার মাকে সে জানায়, ‘মেন ইয়া ম্রো তাকে ধর্ষণ করেছে।’ পরে পাড়ার লোকজন মিলে ভোরে বান্দরবান সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন।

বান্দরবান সদর হাসপাতালে রক্তাক্ত অবস্থায় শিশুটিকে ভর্তি করা হয় গত ৮ জুন সকাল ৮টার দিকে। হাসপাতালের আরএমও ডা. দিলীপ চৌধুরী জানালেন, পায়ুপথ ও জরায়ুর ৯০ শতাংশ কাটা-ছেঁড়া—একটি নিষ্পাপ শরীরকে এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে যে তা শোনার পরেও কারো হৃদয় না কাঁপলে, সে মানুষ নয়। রক্তস্রাবে শরীর ফ্যাকাশে, বেঁচে থাকা যেন অলৌকিক এক ব্যাপার। অথচ, এই ভয়াবহতার পরও মিডিয়া নীরব, মানবতা নির্বাক।

জেএসএস সম্প্রতি আগাস্টিনা চাকমার মাধ্যমে জাতিসংঘে পাহাড়ে কথিত ধর্ষণ ও নিপীড়নের একচোখা চিত্র তুলে ধরেছে। সেখানে বাঙালি সেনা কিংবা সাধারণ বাঙালিকে অপরাধী দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নামে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা চলছে। অথচ, উপজাতিদের মধ্যেই যখন অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন সেই ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। এই Selective Humanitarianism কেবল বিভাজন সৃষ্টি করে না, বরং সত্যকে আড়াল করে।

এটাই কি মানবতা? যেখানে ধর্ষণের বিচার অপরাধীর জাতি দেখে হয়? যেখানে একজন অপরাধীর পরিচয় উপজাতি হলে ‘সামাজিক ভুল’ আর বাঙালি হলে ‘জাতিগত ষড়যন্ত্র’? এই বোধই পাহাড়ে বাস্তব সমস্যা নয়, বরং জাতিগতভাবে সংঘবদ্ধ ও উদ্দেশ্যমূলক রাজনীতি।

পাহাড়ের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ধর্ষণকে একটি চতুর রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেছে। যখনই কোনো অভিযোগ উঠে, সেটিকে জাতিগত দাঙ্গায় রূপ দিতে চায় তারা। ‘বাঙালি সেনা ধর্ষক’, ‘উপজাতির উপর নিপীড়ন’ ইত্যাদি স্লোগানের মধ্য দিয়ে পুরো জাতিকেই অপরাধী প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা চলে। অথচ, উপজাতিদের মধ্যেও ধর্ষক থাকে, খুনী থাকে, অপরাধী থাকে—এই সাধারণ সত্যটি যেন তাদের চেতনায় অনুপস্থিত।

এই যে নীরবতা, এই যে নির্বিকার মানবতাবাদ, এটাই অপরাধীদের রক্ষাকবচ। মেন ইয়া ম্রো যদি প্রকাশ্যে ধর্ষণ করেও রেহাই পেয়ে যায়, যদি তার বিরুদ্ধে কোনো বিচারের দাবিতে রাস্তায় মানুষ না নামে, তবে সেই সমাজ শুধু ভেঙে পড়ে না, ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর অপরাধের জন্ম দেয়। অপরাধের সঙ্গে আপস করা মানেই নতুন অপরাধের বীজ বপন করা।

পাহাড়ে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কিছু সংগঠনের একচোখা জাতিগত মনোভাব, ‘বাঙালি মানেই অপরাধী’ ধরনের প্রচারণা পাহাড়কে শান্তির বদলে বিভেদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করছে। অপরাধের বিচার হোক অপরাধীকে কেন্দ্র করে, জাতিকে কেন্দ্র করে নয়।

একটি সমাজ তখনই সুস্থ হয়, যখন সেখানে ন্যায়বিচার থাকে, বিচারপদ্ধতি পক্ষপাতহীন থাকে, আর মানবতা থাকে সকলের জন্য। কিন্তু পাহাড়ে কি তা আছে? একজন ম্রো শিশুর যন্ত্রণার কোনো মূল্য নেই, কারণ অপরাধী আরেকজন ম্রো?

আমরা চাই, এই ধর্ষণের নৃশংস ঘটনার প্রকৃত তদন্ত হোক। মেন ইয়া ম্রোকে গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক। আমরা চাই, এই শিশুর জন্য সুবিচার নিশ্চিত হোক। শুধু তাই নয়, আমরা চাই, অপরাধী যে-ই হোক, তার পরিচয় বা জাতি দেখে বিচার যেন না হয়।

সমাজকে যদি অপরাধমুক্ত করতে হয়, তবে ‘উপজাতি মানেই নির্যাতিত, আর বাঙালি মানেই নির্যাতনকারী’—এই অপচিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পাহাড়ে শান্তি আনতে হলে সত্যকে দেখতে হবে উন্মুক্ত চোখে, আর ন্যায়ের পক্ষ নিতে হবে দল-মত, জাতি-পংশ নির্বিশেষে।

 

আগের পোস্টবাঘাইছড়িতে ইউপিডিএফ সেকশন কমান্ডার নিহত ও শিশু গুলিবিদ্ধ।
পরের পোস্টমানিকছড়িতে সেনা অভিযানে ইউপিডিএফ সদস্য আটক, অস্ত্র উদ্ধার।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন