কল্পনা চাকমা অপহরণ নাটক ও সেনা-বাঙালি বিতাড়নের ধৃষ্টতা।

0

হান্নান সরকার

১২ জুন ২০২৫ — পাহাড়ে ইউপিডিএফ-এর নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) কর্তৃক ঘোষিত নারী সমাবেশের ঘোষণাপত্র পড়লে যে-কোনো রাষ্ট্রবাদী নাগরিক বিস্মিত না হয়ে পারেন না। যেখানে সেনা ও তথাকথিত “সেটলার বাঙালি”দের “নারীর প্রধান হুমকি” আখ্যা দিয়ে পাহাড় থেকে তাদের সরিয়ে নেওয়ার মতো ধৃষ্টতা প্রকাশ করা হয়। মূলত, এটি শুধু রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত এবং স্বাধীনতা-স্নাত ভূখণ্ডে তথাকথিত জাতিগত রাজনীতির নামে রাষ্ট্রবিচ্ছিন্নতাবাদী ষড়যন্ত্রের ঘৃণ্য প্রতিচ্ছবি।

“সেটলার” বলতে কোনো জাতি নেই। এটি একটি বিভাজনমূলক অপপ্রচারের অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা বসত গড়েছে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রের অনুমতিক্রমে। ১৯৭৯ সালে সরকারি উদ্যোগে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হলেও তার বহু পূর্ব থেকেই, মোগল, ব্রিটিশ আমলের বহু পূর্ব থেকে বাঙালিরা পাহাড়ে অবস্থান করছিল। অপরদিকে, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, ম্রো, খিয়াং প্রমুখ উপজাতি জনগোষ্ঠীর আদি ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, তারা ভারত, মায়ানমার, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেছে মোগল ও ব্রিটিশ আমলে।

যদি আপনি শান্ত-স্বভাব, নিরীহ প্রবীণ চাকমা নাগরিকদের সামনে একবার প্রশ্ন রাখেন— “আপনারা আদিতে কোথা থেকে এসেছেন?” তাঁরা দ্বিধাহীনভাবে উত্তর দেবেন—“আমাদের আদি নিবাস ছিল মায়ানমারের চম্পক নগরে।”

একই প্রশ্ন যদি মারমা সম্প্রদায়ের কারো কাছে করেন, তাঁরাও অকপটে স্বীকার করবেন— “আমরা মায়ানমার থেকেই আগত।” প্রয়াত বোমাং সার্কেল চীফ অংশৈপ্রু চৌধুরীর বক্তব্য তারই উদাহরণ হতে পারে।

বম জনগোষ্ঠীর অনেক সদস্য বলবেন—তাঁরা মায়ানমারের ‘লাই’ (Lai) জনগোষ্ঠীর একটি শাখা। আর ত্রিপুরা সম্প্রদায় বারবারই উল্লেখ করেন— তাঁরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন। তাঁরা মূলত মঙ্গোলীয় মহাজাতির অন্তর্গত একটি শাখা।

এই স্বীকারোক্তিগুলোর তাৎপর্য কী?

এগুলো কোনো গবেষকের রচনা নয়, কোনো সরকারি বিবৃতি বা ব্লগার, সাংবাদিকের ভাষ্যও নয়। এগুলো হচ্ছে ঐ জনগোষ্ঠীর প্রবীণ সদস্যদের মুখে-মুখে প্রচলিত নিজস্ব স্মৃতিকথন। আর তাই, এগুলোর গুরুত্ব অসামান্য—কারণ নিজের মুখে দেওয়া স্বীকারোক্তি যে কোনো প্রকার লিখিত ইতিহাসের চেয়েও অধিক শক্তিশালী দলিল।

উপরিউক্ত কথাগুলো থেকে এটি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়— পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতি সম্প্রদায়গুলো মূলত মঙ্গোলিয়া, ভারত ও মায়ানমার থেকে বিভিন্ন সময়, যুগে অভিবাসন করে এই অঞ্চলে আগমন করেছেন। এছাড়াও এ বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রচুর গবেষণা, ঐতিহাসিক প্রমাণ ও প্রামাণ্য দলিল বিদ্যমান।

এই বাস্তবতা জেনেও কিছু গোষ্ঠী আজ নিজেদের “আদিবাসী” বা “উদ্ভবস্থানীয় জনগোষ্ঠী” হিসেবে দাবি করছেন, যা মূলত একটি রাজনৈতিক প্রচারণা ও আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়ের কৌশল মাত্র।

এসব গোষ্ঠী থেকে উৎসারিত সন্ত্রাসীচক্র ও তাদের মদদপুষ্ট মহল কী অধিকারবোধে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী ও বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বিতাড়নের দুঃসাহস দেখায়? এই ঔদ্ধত্যের (ধৃষ্টতা) উৎস কোথায়? সময় এসেছে—তাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলে রাষ্ট্রীয় শক্তির যথার্থ প্রয়োগ ঘটানোর।

কল্পনা চাকমা: অপহরণ না, পরিকল্পিত আত্মগোপন?

ইউপিডিএফ ও তার সমর্থক মহলের নিরন্তর প্রচার—সেনা কর্মকর্তা লে. ফেরদৌস কর্তৃক কল্পনা চাকমা অপহরণ—আজ ২৯ বছরেও প্রমাণহীন ও অবাস্তব। এই অপহরণ যে একটি সাজানো নাটক ছিল, তা কল্পনার রাজনৈতিক পরিচয় ও ঘটনাপর্ব বিশ্লেষণেই স্পষ্ট।

কল্পনা ছিলেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি শাখার সাংগঠনিক সম্পাদিকা এবং পিসিজেএসএস (তৎকালীন শান্তিবাহিনী)-এর প্রত্যক্ষ সমর্থক। তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল ভারতের অরুণাচলের অরুণ বিকাশ চাকমার সঙ্গে, যিনি পিসিপি’র (পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ) কর্মী ছিলেন। কল্পনার প্রেমিক ও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে কল্পনাকে অপহরণ করে ভারতের অরুণাচলে পাঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধেই।

১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে পিসিজেএসএস সমর্থিত প্রার্থীর বিপক্ষে কল্পনার আওয়ামী লীগপন্থী প্রচারণা তাদের অসন্তোষের কারণ হয়। ফলে ‘সংগঠনের বিরোধিতা’ এবং ‘দলদ্রোহিতা’র অভিযোগে তাকে পথের কাঁটা হিসেবে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরিণামে, নিজ গোষ্ঠীই তাকে পরিকল্পিতভাবে গুম করে।

সেনাবাহিনী ও লে. ফেরদৌসের বিরুদ্ধে অপবাদ : প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?

ঘটনার দিন সকালে নির্বাচনের দায়িত্ব পালনের জন্য লে. ফেরদৌস উগলছড়ি ক্যাম্পে আসেন। সেখানে এক মেজর, এক ক্যাপ্টেন, দুই লে. এবং প্রায় ৯০ জন সৈন্য উপস্থিত ছিল। তারা রাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিলেন, এমনকি ওই রাতে কোনো গুলির শব্দ, হতাহতের খবরও নেই।

অথচ অপহরণের সময় “সেনাবাহিনীর গুলি” চালানোর দাবি করা হয়—যার কোনো বাস্তব সাক্ষ্য নেই।

কল্পনা চাকমার বড়ভাই কালিন্দী চাকমা কর্তৃক মামলাও করা হয় “অপরিচিত ব্যক্তিদের” বিরুদ্ধে—সেনাবাহিনীকে জড়ানো হয়নি। প্রশ্ন ওঠে—যদি সত্যিই সেনা সদস্যরা অপহরণে জড়িত হতো, তাহলে তাদের নাম বাদ দিয়ে মামলা দায়েরের কোনো যুক্তি থাকে কি?

আসলে লে. ফেরদৌস ছিলেন সন্ত্রাসীদের আতঙ্ক। তার সফলতা পাহাড়ে শান্তিবাহিনী ও পিসিপি’র দমন কার্যক্রমে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নির্বাচনে কারচুপি ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কায় সংগঠন ভেঙে পড়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছিল। সেখান থেকেই লে. ফেরদৌসের নামে অপহরণের অপবাদ বসানো হয়।

ইউপিডিএফ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর “নারী সমাবেশ” বা “নারী অধিকার” প্রসঙ্গ আসলেই দ্বিমুখী। পাহাড়ে বারবার দেখা গেছে—তাদের সন্ত্রাসী কর্মসূচি চালাতে গিয়ে সাধারণ উপজাতি নারীদেরও তারা ব্যবহার করেছে ঢাল হিসেবে। অথচ সেসব নারীর প্রকৃত নিরাপত্তা ও অধিকার কখনো তাদের দাবিতে মুখ্য নয়, মুখ্য হলো রাষ্ট্রদ্রোহী প্রচারণা এবং সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের বিতাড়নের মাধ্যমে একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল গড়ে তোলার স্বপ্ন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে কল্পনা চাকমার অপহরণ ইস্যুকে কেন্দ্র করে বারবার সেনাবাহিনীকে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস বন্ধ হওয়া জরুরি। রাষ্ট্রের উচিত, অতীত ইতিহাস ও সত্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট বার্তা দেওয়া—

১. কল্পনা চাকমা অপহরণ একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।
২. সেনাবাহিনী কখনোই সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করে না বরং পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান হাতিয়ার।
৩. “সেটলার” বলে বাঙালিদের নিজ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়নের দাবি রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।
৪. ইউপিডিএফ, পিসিজেএসএস, কেএনএফ-সহ সকল অস্ত্রধারী উপজাতি সংগঠনের রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

কল্পনা চাকমা অপহরণের নাম করে যেভাবে সেনাবাহিনীর সম্মানহানি ও বাঙালিদের হেয় করা হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে একটি গভীর ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখা এবং একটি তথাকথিত “স্বশাসিত” ভূখণ্ডের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চক্রান্ত।

আমরা বলি—“কল্পনা চাকমা কোথায়?” প্রশ্ন নয়, সত্য জানতে চাও। আর সত্য হলো—তাঁকে অপহরণ করেছে তাদেরই একদল, যারা আজও নিজের অপকর্ম ঢাকতে সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করছে।

আগের পোস্টবমু রিজার্ভের তদন্তের আলামত নষ্ট করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে লামা বনবিভাগ।
পরের পোস্টকাউখালীতে গুলি করে হত্যার চেষ্টা: ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন