নওমুসলিম শহীদ ওমর ফারুক: পাহাড়ে ঈমানি রক্তের অবহেলিত আর্তনাদ।

0
ছবি: নিজের নির্মিত মসজিদের পাশে ওমর ফারুক ত্রিপুরা

শহীদের রক্তে রাঙা তুলাছড়ি: এক নওমুসলিম ইমামের আত্মত্যাগ ও অবহেলিত ন্যায়ের করুণ গল্প।

পার্বত্য জনপদে আকাশ ছুঁয়ে থাকা বৃক্ষের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া এক নাম, শহীদ মুহাম্মাদ ওমর ফারুক ত্রিপুরা। এক প্রান্তিক, নিরীহ, অথচ ঈমানী দৃঢ়তায় অবিচল পুরুষ। যার জীবন যেন এক দীপ্ত প্রদীপ, আর মৃত্যু— হিংস্র অন্ধকারের নির্মম নিধন। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার তুলাছড়ি এলাকায় ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করা এ মানুষটির হত্যাকাণ্ড আজও অমীমাংসিত, অপরাধীর দল আজও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

থানচির এক সহপাঠী থেকে ইসলাম ধর্ম ও নবী রাসুল সম্পর্কে জানতে পেরে ২০১৪ সালে আলীকদমে গমন করে পুর্নেন্দু ত্রিপুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরে যা আইনী স্বীকৃতির জন্য বান্দরবান আদালতে গিয়ে হলফনামা সম্পূর্ণ করেন। এরপর আলোর পথের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি হয়ে উঠেন মুহাম্মাদ ওমর ফারুক— এক সাহসী নওমুসলিম। ধর্মান্তরের পর তার পথ সহজ ছিল না; বরং পদে পদে লাঞ্ছনা, বিদ্বেষ আর প্রাণনাশের হুমকিই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। ধর্মান্তরের চার বছরের মাথায় ২০২৮ সালে দুর্গম তুলাছড়িতে কয়েকটি পরিবারের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং স্বয়ং তার ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাহাড়ের ক্লান্ত মেঠোপথে তিনি ছড়িয়ে দিতেন দাওয়াতের সুবাতাস— কাউকে জোর করে নয়, দিনের পথে আসার জন্য ভালোবাসা ও যুক্তিবোধের ভিত্তিতে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতেন।

ছবি:  পূর্ব নাম পুর্নেন্দু ত্রিপুরা, বর্তমান নাম শহীদ ওমর ফারুক ত্রিপুরা

এই নিরীহ ধর্মপ্রচারেই চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন জেএসএস তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে খ্রিস্টান ধর্মের গির্জা ও মিশনারি কার্যক্রমে জেএসএসের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু উপজাতি বৌদ্ধ, কিংবা ত্রিপুরা হিন্দু থেকে কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের কাছে তা চরম ‘অপরাধ’। ওমর ফারুক ছিলেন এই অপরাধের এক জ্বলন্ত উদাহরণ।

তাঁর জীবনকে শেষ করে দেওয়ার জন্য যেই নিষ্ঠুর অধ্যায়টি রচিত হয়, তা ছিল ২০২১ সালের ৬ জুন, শুক্রবারের রাত। এশার নামাজের পর, যখন পাহাড়ি অন্ধকার নিস্তব্ধতায় ডুবে ছিল, তখন জেএসএস এর একটি সশস্ত্র দল ওমর ফারুকের নিজ ঘরে প্রবেশ করে। স্ত্রী রাবেয়া বেগম যখন স্বামীকে রক্ষার চেষ্টা করেন, তখন এক সন্ত্রাসী তাঁর বুকে প্রচণ্ড লাথি মেরে ছিটকে ফেলে দেয়। চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিথর হয়ে যান তার স্বামী— একজন ইমাম, একজন অভিভাবক, একজন আলোকবর্তিকা।

কিন্তু এ ঘটনা ঘটার আগেও মৃত্যু হুমকির মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। ঢাকায় তাবলীগের একচিল্লা শেষ করে ফিরে এসে তিনি আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। সন্ত্রাসীরা যখন প্রাণনাশের হুমকি দেয়, তখন তিনি বুক চিতিয়ে বলেছিলেন—
“ধর্ম গ্রহণ আমার ব্যক্তি স্বাধীন অধিকার। যদি মৃত্যুই চাও, আমি প্রস্তুত। শহীদ হয়ে যাবো!”
পাঞ্জাবির বোতাম খুলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। সেই দৃঢ়তা, সেই ঈমানি সাহস কোনো ব্যালটের নয়, বরং শাহাদাতের। জেএসএস সন্ত্রাসীরা তার মাথা ও বুকে গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করে।

এই হত্যাকাণ্ডের পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। জাতীয় পত্রিকার শিরোনামে আসে তুলাছড়ির এই নির্মম অধ্যায়। নওমুসলিম ইমামের স্ত্রীর আর্তি, সন্তানের চোখের পানি, প্রতিবাদমুখর জনতার ন্যায়বিচারের আহ্বান— সব মিলিয়ে এক জ্বলন্ত গণচেতনা সৃষ্টি হয়। অথচ সময়ের গর্ভে হারিয়ে যায় ওমর ফারুকের নাম, নিস্তব্ধতায় বিলীন হয়ে যায় তাঁর পরিবারের দুঃখগাঁথা।

তার স্ত্রী বাদী হয়ে ১৯ জুন ২০২১-এ হত্যা মামলা দায়ের করেন (নং-১/২০২১)। কিন্তু আজ কয়েকটি বছর পেরিয়ে গেলেও জেএসএস এর কোনো ঘাতককে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এবং পাহাড়ে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার নামে গৃহীত আপসনীতিই এই অবিচারের মূল কারণ।

জেএসএস এ অঞ্চলে নিজস্ব মতাদর্শের নামে একধরনের ‘ধর্মীয় আগ্রাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়— যেখানে শুধুমাত্র একধরনের সংস্কৃতি ও চিন্তা বহাল থাকবে। তাই ওমর ফারুকের ইসলাম গ্রহণ ও দাওয়াত কার্যক্রম তাদের সহ্য হয়নি। এই হত্যাকাণ্ড তাদের ধর্মবিদ্বেষী মুখোশ খুলে দিয়েছে। অথচ এতো বড় অপরাধের পরেও এক বিন্দু অনুশোচনাও তারা প্রকাশ করেনি।

এই খুনের পর তার স্ত্রী ও চার সন্তান— হাফসা, আমেনা, মায়মুনা ও ইব্রাহীম— চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে। জানা যায়, তাদের নওমুসলিমদের একটি দল বান্দরবান জেলা সদরে পালিয়ে আশ্রয় নেয়, এবং দীর্ঘদিন হোটেল থেকে খাবার চেয়ে জীবনধারণ করে। কেউ তাদের খোঁজ রাখেনি। অনেক নওমুসলিম পরিবার ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলামে প্রবেশ করলেও, এই হত্যাকাণ্ডের পর নিরাপত্তার অভাবে তারা পূর্বের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে নতুন পরিচয়ে বাঁচতে চেয়েছে।

এই ঘটনা শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়— এটি হলো ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর সরাসরি আঘাত, একটি পরিবারের স্বপ্ন ও বিশ্বাসকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার দলিল। ওমর ফারুক শুধু একজন ত্রিপুরা ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবতার প্রতীক, বিশ্বাসের শহীদ, আর রাষ্ট্রের দায়হীনতার এক জীবন্ত দলিল।

আজও তার সন্তানরা অপেক্ষায় আছে— একদিন বিচার হবে, একদিন বাবার রক্তের দাম রাষ্ট্র দেবে। কিন্তু এই দীর্ঘশ্বাস যেন আকাশ ছুঁয়ে যায়, তবুও প্রশাসনের কর্ণপাত হয় না।

শহীদ মুহাম্মাদ ওমর ফারুকের স্মরণে আজ প্রয়োজন—

  • (১)আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জেএসএস এর কার্যক্রম তদন্তের দাবি।
  • (২)ওমর ফারুকের পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদান।
  • (৩) পার্বত্য এলাকায় ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে স্পষ্ট আইন প্রয়োগ।

হয়তো কোনোদিন তার মতো একজন সাহসী উপজাতি আবারও আলোকে আলিঙ্গন করবে, বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে পাহাড়ের উঁচু শিখরে, আর বলবে—
“তোমরা আমাকে মারতে পারো, কিন্তু আলোর পথ থামাতে পারবে না!”

 

আগের পোস্টবান্দরবানে যুবদল নেতা অপহৃত, উপজাতি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ।
পরের পোস্টরাঙামাটিতে ওমর ফারুক ত্রিপুরার স্মরণে পিসিসিপি’র শোক সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন