সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কলেজ প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন, বাস্তবতা ও দ্বন্দ্বের কৌশলে পরিবর্তিত এক চিত্র।

0

পরিবর্তিত বিশ্বে উন্নয়নকে আরও আধুনিক ও প্রযুক্তির আলোকে দেখা হয়েছে। কিন্তু একদিকে, উন্নয়নমূলক কার্যক্রম যখন সংরক্ষিত বনভূমি ও প্রাচীন সংস্কৃতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তখন সেটা স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও পরিবেশের প্রতি আঘাত হানে বাধ্য হয়। আজকের আলোচনার মূল বিষয়ঃ পরিবেশ ধ্বংস করে গড়ে ওঠা নতুন এক কলেজের অবৈধ প্রতিষ্ঠা।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নের ধারাও ব্যাপক পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছে। নানা উন্নয়ন প্রকল্প, যে সকল আশেপাশের জনগোষ্ঠী ও পরিবেশকে প্রভাবিত করে থাকে, সেগুলোর প্রভাব বিশ্লেষণ করা আজকের অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়। গত এক দশক ধরে দেখা যাচ্ছে, বহু উপজাতি সংগঠন সরকারের ওপর আক্রমণাত্মক মতামত রেখে থাকে, যেখানে তারা বিশ্বাস করে—সরকারি স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলি পাহাড়ি জনগণের জীবিকা এবং পরিবেশ ধ্বংস করে ফেলছে। এ ধরনের অভিযোগের মধ্যে একটি উদাহরণ হলো, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ নির্মাণে জেএসএস এর অপ্রত্যাশিত বাধা ছিল। ২০২১ সালে মহালছড়ি ও সিন্দুকছড়ি সড়কের পঙ্কিমুড়া পল্লীভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নির্মাণে সেনাবাহিনীর নিয়োজনে ঘটনা সংঘটিত হয়, তখন ইউপিডিএফ সেনাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারণা চালিয়ে উঠেছিল। ভূমি দখলের গুরুতর অভিযোগ করেছিল। ফেইক ভূমির মালিক সাজিয়ে তার ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ছিল৷ অথচ প্রকৃত ভূমি ছিল খাস। পরবর্তীতে পরিস্থিতি এতটা নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়, সেই জায়গার পার্শ্ববর্তী সেনাবাহিনী ওই উপজাতিকে একটি ঘর নির্মাণ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

সম্প্রতি জানা গেছে, রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের উজোবাজার এলাকায় সরকারের সংরক্ষিত বনভূমিতে একটি নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। সরকারি আদেশ ও নির্দেশনা উপেক্ষা করে, এই এলাকায় টিনসেড বিল্ডিং নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করার ঘটনাটি বিশেষ চেনা যাচ্ছে। প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ‘সাজেক কলেজ’ নামে এই অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে।

প্রথম পর্যায়ে মার্চ মাসের শুরু থেকেই এই নির্মাণ কাজ নজরে এসেছে। সংরক্ষিত রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকায় অবৈধভাবে চলে আসা এই নির্মাণ কার্যক্রম ছিল এক ধরনের সন্ত্রাসী চক্রের সূচনা। পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লিখিতভাবে কাজ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও, কিছুদিনের বিরতির পর বুধবার (২৫ জুন) দুপুর থেকেই পুনর্বার নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এবং পরিবেশ পরিস্থিতি ঘুরে দেখে বাস্তবতার এক নির্মম চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উদ্দেশ্যমূলক বিশ্লেষণ বা সরকারি প্রতিবেদন নয়, বরং পাহাড়ের মাটি, গাছ আর জীবনের গভীরে থাকা মানুষের অভিজ্ঞতা আমাদের জানায়—এই ‘সাজেক কলেজ’ নামে গড়ে ওঠা স্থাপনাটি নিছক শিক্ষার কেন্দ্র নয়। এটি ইউপিডিএফ-এর সংগঠিত কৌশলেরই একটি অংশ, যা ভবিষ্যতে তাদের রাজনৈতিক ও সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে।

একজন বয়স্ক গ্রামবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “এই কলেজের নামে যে বিল্ডিংটা উঠছে, এটা আমরা ঠিক কলেজ মনে করি না। আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য তো আগে কখনও কেউ কিছু করেনি। এখন হঠাৎ এত ‘ভালোবাসা’ কেন?” তার চোখে ছিল আতঙ্কের চাপ—যা শুধু সন্দেহ নয়, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও প্রতারণার ঘা থেকে জন্ম নিয়েছে।

বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত ও স্থানীয় পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে, এই নির্মাণ প্রকল্পটি পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষিত বনভূমিকে ধ্বংস করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের অংশ। বনের নিস্তব্ধতা আর উপজাতি গ্রামগুলোর নির্জনতা যেন এদের কাছে এক ‘কৌশলগত সুবিধা’ হয়ে উঠেছে।

এক পাড়া কার্বারী বলেন, “সাজেকে পর্যটন, তথা পর্যটকদের ইবাদতের জন্য নির্মিতি মসজিদ নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্য থাকে সেখানে কলেজ দাবি আমার কাছে বিস্ময়কর।”

ইউপিডিএফ কেন সাজেকে কলেজ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত, তা বলার কারণ কী? গত ১৬ জুন ২০২৫ বিকালে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয় ইউপিডিএফ-সমর্থিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে। ওই স্মারকলিপিতে বলা হয়, রাঙামাটির সাজেকে কলেজ নির্মাণে প্রশাসনের বাধার প্রতিবাদ এবং দ্রুত কলেজ নির্মাণের দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টার বরাবর আবেদন জানিয়েছে। এছাড়াও ইউপিডিএফ পিসিপি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে প্রশাসনের বাধার অভিযোগে। ফলে স্পষ্ট হয়, এই কলেজ নির্মাণে ইউপিডিএফের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে।

উপজাতি সংগঠন ও সরকারের দ্বন্দ্ব:

উপরোক্ত ঘটনাটির পেছনে আরও একটি গভীর দিক হলো—উপজাতি সংগঠনগুলোর ক্রোধ। এই সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উপজাতিদের জীবনযাত্রার উপর আক্রমণাত্মক উন্নয়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। উন্নয়ন প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে এ অভিযোগ উঠেছে যে, সরকার ও কিছু নির্ধারিত গ্রুপ শুধুমাত্র উন্নয়ন হিসেবে প্রমাণিত ভেসে পার্বত্য অঞ্চলের প্রকৃতির ও পাহাড়িদের জীবনধারার ক্ষতি করে যাচ্ছে।

বিশেষ করে, যখন এধরনের অবৈধ কৌশলে সংরক্ষিত বনভূমির উপর চাপ পড়ে, তখন উপজাতি জনগণের বিশ্বাস আরও নিঃসৃত হয় যে—সরকারের পক্ষপাতিত্বে উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুধু অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক লাভের দিকে তাকানো হচ্ছে। এদিকে, ইউপিডিএফ এর আচরণও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ২০২১ সালে দেখা যায়, যখন কোনও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন ছিল, তখন ইউপিডিএফ বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি ও অপপ্রচারের মাধ্যমে প্রকল্পটিকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করেছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, বর্তমান প্রতিষ্ঠার নামে শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যের পাশাপাশি এর অন্তরালে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র কার্যক্রম প্রসারিত কৌশলো ভূমিদখলের উদ্দেশ্য নिहিত রয়েছে।

পরিবেশ ধ্বংস ও এলাকার সামাজিক প্রভাব:

সংরক্ষিত বনভূমি শুধু বায়ু ও জলবায়ুর জন্য নয়, বরং স্থানীয় জীববৈচিত্র্য এবং উপজাতি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও এক অপরিহার্য অংশ। এই এলাকায় অবৈধভাবে নির্মিত কলেজটি যদি কার্যকরী হয়, তাহলে তা শুধুমাত্র স্থানীয় পরিবেশের উপর না হারিয়ে, বরং জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকেও মারাত্মক প্রভাবিত করবে।

স্থানীয় বাসিন্দারা ভয় প্রকাশ করেছেন যে—এই কলেজের মাধ্যমে ইউপিডিএফ একদিকে জমি দখলের উদ্দেশ্য সাধন করবে, অন্যদিকে সাংগঠনিক শক্তির জন্য সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। এটা বিশ্বাস করা হচ্ছে যে, ভবিষ্যতে এই জায়গাটি কেবল শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং একটি সংগঠিত ও সশস্ত্র সংগঠনের ‘আতুরঘর’ হয়ে উঠতে পারে, যা এলাকার শান্তি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি। পাহাড়ে এমন অনেক স্কুল কলেজ ইউপিডিএফ এর সাংগঠনিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়।

পরিবেশবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, “উন্নয়ন প্রকল্প কোনোদিনই প্রকৃতির প্রতি অনৈতিকভাবে আক্রমণ করতে পারে না। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনে কোনো রাজনৈতিক বা সশস্ত্র কার্যক্রম নিয়ে প্রসারিত উদ্দেশ্য নিহিত থাকে, তাহলে তা আমাদের পরিবেশ ও সমাজের জন্য মারাত্মক বিপর্যয়ের সূত্রপাত হতে পারে।” এমন একটি স্থাপনা শুধুমাত্র জমির অপব্যবহার নয়, বরং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

সরকারের নীতিমালা ও কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া:

সরকারি আদেশ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে—সংরক্ষিত বনভূমিতে কোনো ধরনের অবৈধ নির্মাণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমন একটি অবস্থায়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লিখিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে যে, অনুমোদন ছাড়া নির্মাণ কার্যক্রম আইনসাপেক্ষে অপরাধ।

তবু, বিস্তারিত তত্ত্বাবধানে না নেবার কারণে বা কিছু জোটের সমন্বয়ে কাজ থামিয়ে না রাখার ফলে, নির্মাণ কাজ পুনরায় শুরু হয়ে গেছে। এ ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে—সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে এখন আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে, আদালত, পুলিশ ও বন বিভাগের মধ্যে আরও সমন্বয় সাধনের আহবান উঠেছে, যাতে অবৈধ নির্মাণ কার্যক্রমকে সম্পূর্ণভাবে দমন করা যায়।

অনন্ত অসীম, রাঙামাটি 

আগের পোস্টবান্দরবানে ৬ লাখ টাকা-চাঁদার রসিদসহ ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ছয় গ্রেপ্তার।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন