রক্তমাখা প্রভাত, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্রবাজ ইউপিডিএফ-এর বিপজ্জনক পুনরুত্থান।

0
ছবি: উদ্ধারকৃত অস্ত্র

পাহাড়ের বুক চিরে সূর্যোদয়ের আগেই গর্জে উঠলো গুলি—না, এটি কোনো যুদ্ধকালীন সিনেমার দৃশ্য নয়। এটি বাস্তব। রাঙামাটির কাউখালীর ঘাগড়া ইউনিয়নের মইনেপাড়া স্কুলসংলগ্ন এলাকায় মঙ্গলবার ভোরে যে ভয়াবহ গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে, তা আবারও উন্মোচিত করে দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘাপটি মেরে থাকা এক ভয়ানক বাস্তবতাকে—ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) নামক সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের উত্থান ও অস্ত্রভাণ্ডারের বিস্তার।

ইউপিডিএফ নামটি শুনলেই এখন কাঁপে পার্বত্য জনপদ। “জাতিসত্তার অধিকারের” মোড়কে যারা দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদ চালিয়ে আসছে, তারা আদতে এক অশুভ শিকড় বিস্তারকারী সংগঠন, যার লক্ষ্য একটিই—রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে দিয়ে জনসাধারণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, আর চাঁদাবাজির মাধ্যমে অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা।

২৪ জুন ঘটনার দিন ভোর ৪টা ১০ মিনিট থেকে ৫টা ৫ মিনিট পর্যন্ত যে অবিরাম গুলির লহরিতে কেঁপে ওঠে পাহাড়ি নিস্তব্ধতা, তা নিছক সংঘর্ষ নয়—এটি ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘাপটি মারা এক নিষ্ঠুর চক্রান্তের বহিঃপ্রকাশ। ২৩ জুন সন্ধ্যায় ফুরমোন সেনা টিওবি থেকে একটি সেনা টিম মইনেপাড়া টহলে গেলে মেজর সুদর্শন নামে ইউপিডিএফ (প্রসীত)- এর কমান্ডার পরিচয়ে মোবাইল ফোনে টহল কমান্ডারকে হুমকি দিয়ে এলাকা ছেড়ে যেতে বলেন।

প্রশ্ন ওঠে— সেনাবাহিনীকে এই হুমকি দেওয়ার দুঃসাহস কীভাবে হয়? স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, অবৈধ অস্ত্রের জোর। এতো ভারী অস্ত্র, এসএমজি রাইফেল, গোলাবারুদ—এসব কোথা থেকে আসে ইউপিডিএফ-এর হাতে? পার্বত্য চট্টগ্রাম তো বাংলাদেশের ভূখণ্ড, এখানে বৈধ অস্ত্রের প্রাপ্তি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। তাহলে এই মারাত্মক অস্ত্রভাণ্ডার আসে কোথা থেকে?

বিশ্লেষকদের মতে, ইউপিডিএফ তাদের অস্ত্রের সরবরাহ পায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের মাধ্যমে, যারা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে এই অঞ্চলে অস্ত্র পাচারের অশুভ মদদ দিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো হয়ে উঠেছে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রবেশদ্বার। পাহাড়ি বনাঞ্চল আর দুর্গম ভূপ্রকৃতি এই অপকর্মে আরও সহায়ক হয়ে উঠেছে।

সেনা সদস্য আহত একটি গভীর সংকেত—

উক্ত অভিযানে সেনাবাহিনীর একজন সদস্য মো. তরিকুজ্জামান খান গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। তাঁর ডান হাতের আঙুল ঝাঁজরা হয়ে গেছে। দ্রুত হেলিকপ্টারে চট্টগ্রামের সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয় তাঁকে। একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যকে এভাবে আহত করা নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটি এক ভয়ঙ্কর প্রমাণ যে ইউপিডিএফ-এর কাছে যে অস্ত্রভাণ্ডার রয়েছে, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক ও পেশাদার মানের।

সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার ও বিপর্যয়ের বীজ—

ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী লেবারপাড়া সেনা ক্যাম্প পূর্বে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। এই কৌশলগত ভুলের কারণেই ইউপিডিএফ কজইছড়ি মইনেপাড়া এলাকায় পুনরায় ঘাঁটি স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সেনা উপস্থিতির শূন্যতা ইউপিডিএফ-এর মতো সশস্ত্র সংগঠনের জন্য আশীর্বাদ হয়ে ওঠে। এতে শুধু অস্ত্র মজুদের সুযোগই বাড়ে না, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও ভীতিপ্রদর্শন আরও বেপরোয়া হয়।

সেনাবাহিনীর সফল অভিযানে ইউপিডিএফ-এর তিন সদস্যকে এসএমজি রাইফেল, গোলাবারুদ, সরঞ্জামাদিসহ আটক করা হয়—মনসুখ চাকমা (৫০), সিন্ধু মনি চাকমা (২৩), ও অন্তর চাকমা (১৯)। এই গ্রেপ্তার দেখিয়ে দেয় যে, বিভিন্ন বয়সের পাহাড়িদের এ সংগঠন নিজেদের করাল ছায়ায় এনে সন্ত্রাসের খাঁচায় আবদ্ধ করে রাখে।

দুই প্রজন্মব্যাপী সন্ত্রাসী নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা এক অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে রাজনৈতিক আদর্শের নামে অস্ত্র ও সহিংসতার কুটিল চর্চা চলছে।

বর্ণিত ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক ও নিরাপত্তার সংকট—

ঘাগড়া উল্টোপাড়ার এক নিরীহ পাহাড়ি ব্যক্তি পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন সংঘর্ষ চলাকালীন। এটি দেখিয়ে দেয়, এই সংঘাত কেবল সেনা ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না—এটি সাধারণ মানুষের জীবনেও আঘাত হানে। এতে পাহাড়ি সমাজে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়ে, যা নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার জন্য উদ্বেগজনক।

পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন—

বর্তমান অবস্থা স্পষ্ট করে দেয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা উপস্থিতির ঘাটতি একটি গভীর নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি করছে। ইউপিডিএফ-এর মতো সংগঠন এই শূন্যতাকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছে। অতএব, পাহাড়ি অঞ্চলে সেনা ক্যাম্প পুনঃস্থাপন, স্থানীয় প্রশাসন ও জনসাধারণের সঙ্গে সমন্বিত নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি এখন সময়ের দাবি।

রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও আন্তর্জাতিক সংযোগ—

ইউপিডিএফ দীর্ঘদিন ধরে কোনো না কোনোভাবে কিছু বাম সংগঠন ও স্বার্থান্বেষী মহলের ছত্রছায়ায় পরিচালিত হয়েছে—এটি কারও অজানা নয়। এই গোষ্ঠীগুলো তাদের “আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি”কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ও জনবিচ্ছিন্ন অপারেশনকে আড়াল করে। এসব কর্মকাণ্ডে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা এখন সময়ের অপরিহার্যতা।

রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে সন্ত্রাসের বীজ—

মইনেপাড়া অভিযান ছিল একটি গভীরতর সংকেত—পার্বত্য চট্টগ্রামে অঘোষিত যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। সেখানে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। অবৈধ অস্ত্র, চাঁদাবাজি, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, সীমান্তপারের মদদ—সবকিছু মিলে ইউপিডিএফ এখন আর নিছক একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়; এটি পরিণত হয়েছে এক অতিমাত্রিক হুমকিতে, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও একতাকে বিনষ্ট করার ক্ষমতা রাখে।

এই পরিস্থিতিতে, প্রয়োজন সুপরিকল্পিত, সংবেদনশীল ও দৃঢ় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ—যেখানে কৌশল, সামরিক সক্ষমতা, গোয়েন্দা দক্ষতা ও জনসম্পৃক্ততা মিলিয়ে একটি দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম কেবল ভূখণ্ড নয়—এটি আমাদের জাতীয় অখণ্ডতার অংশ। এখানে সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই।

 

 

 

আগের পোস্টসেনাবাহিনী ও ইউপিডিএফ-এর ভয়াবহ গুলিবিনিময়: আহত ২, অস্ত্রসহ আটক ৩
পরের পোস্টবান্দরবানে ৬ লাখ টাকা-চাঁদার রসিদসহ ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ছয় গ্রেপ্তার।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন