রাবিপ্রবির রাতের অস্ত্রধারী টহল—শিক্ষাঙ্গনে বিপদের বার্তা।

0

রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) রাতের আকাশে যখন পাহাড়ি নিস্তব্ধতা নেমে আসে, তখনই গর্জে ওঠে এক অজানা আতঙ্ক। ২৬ জুন, বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিট—একটি সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে এমন দৃশ্য, যা কেবল চমকে দেওয়ার জন্য নয়, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অস্ত্র হাতে ৭-৮ জনের একদল লোক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে টহল দিচ্ছে—একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মত শান্ত জ্ঞানের চারণভূমিতে যদি রাতের আঁধারে বন্দুকের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়? এই প্রশ্ন এখন কেবল ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক বা অভিভাবকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং গোটা জাতির সামনে এক ভয়ংকর বার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সশস্ত্র উপস্থিতি, নিছক টহল না পরিকল্পিত প্রহসন?

ভিডিও ফুটেজে যাদের দেখা গেছে, তাদের পরিচয় আজও অজানা। প্রশাসন এখনো নিশ্চিত করে বলেনি—এরা কারা, কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে। এ এক ধোঁয়াশার অরণ্য। তবে স্থানীয় সূত্র, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের গুঞ্জন এবং পার্বত্য অঞ্চলের ইতিহাসকে একসূত্রে গাঁথলে যে চিত্র উঠে আসে, তা আরও ভয়াবহ।

ধারণা করা হচ্ছে, কোনো উপজাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তবে কে বা কারা এর পেছনে, সেটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এলাকাবাসীর আতঙ্কের কোনো পরিসমাপ্তি নেই।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যদি ভয়—তবে শান্তি কোথায়?

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সহিংসতা বা সংঘর্ষ না ঘটলেও পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্বস্তিকর। তারা বাড়তি নজরদারি ও নিরাপত্তা জোরদারের কথা বলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—সেই নজরদারি কতটুকু কার্যকর, যদি রাতের অন্ধকারে অস্ত্রধারীরা অবাধে ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করতে পারে?

সেই একই রাবিপ্রবি, যেখানে এর আগে ১২ মে চাঁদার দাবিতে জেএসএস সন্তু গ্রুপ নির্মাণাধীন একাডেমিক ভবনের কাজ বন্ধ করে দেয়। অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেয়, টাকা না দিলে রক্ত ঝরবে। ওই সময় কাজ বন্ধ হয়ে যায়, পরে টাকা দিয়ে ঠিকাদার কাজ চালিয়ে নেয়—এই বাস্তবতা যেন রাষ্ট্রীয় নতজানুতার নগ্ন দলিল।

চক্রান্তের গভীর বার্তা: শিক্ষার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ শক্তি?

২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) তীব্র বিরোধিতা ছিল। তারা স্পষ্টভাবে চায়নি এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোক। তাদের যুক্তি ছিল—‘বহিরাগত’ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এখানে এসে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর ‘সামাজিক ভারসাম্য’ নষ্ট করবে।

কিন্তু আসল সত্যটা আরও ভয়ানক। শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে এই অঞ্চলে যে আলোকিত তরুণ সমাজ গড়ে উঠবে—তা চায় না এই অস্ত্রনির্ভর গোষ্ঠী। তারা চায়, অন্ধকারেই থাকুক পাহাড়, মূর্খতাই থাকুক প্রধান হাতিয়ার হিসেবে, যাতে তাদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে কেউ মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

রাষ্ট্র কোথায়? মন্ত্রীরা ঘুমিয়ে, মাঠে অস্ত্রধারীরা!

এই ঘটনার পরও এখন পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো বিবৃতি দেয়নি। কোনো হেলিকপ্টার আসেনি, কোনো বাহিনী ‘র‍্যাপিড রেসপন্স’ দেখায়নি। অথচ এ ঘটনার পেছনে স্পষ্ট আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নত, সুপরিকল্পিত আতঙ্ক তৈরির পাঁয়তারা রয়েছে—তা সবাই জানে।

স্থানীয় প্রশাসন বলছে, তারা পাহাড়ি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। কিন্তু অস্ত্রের সামনে সংলাপ কি কখনো সফল হয়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যখন টার্গেট, তখন সেই আগুন নেভানো কি কেবল ফোনালাপেই সম্ভব?

পাহাড়ে আলোর শত্রু কারা?

এই প্রশ্ন আমাদের জাতিগত বিবেককে নাড়া দেওয়া জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ, যারা ‘চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ’ নামে বিভক্ত, মূলত সবাই একই সূঁচে গাঁথা। তাদের উদ্দেশ্য এক—বাংলাদেশের মূল স্রোতের শিক্ষিত সমাজ যাতে পাহাড়ে পা রাখতে না পারে, সেই পথ রুদ্ধ করে রাখা।

বিশ্ববিদ্যালয় মানে ভবিষ্যৎ, জ্ঞান, মুক্তি। আর ঠিক সেটাকেই তারা ভয় পায়। কারণ শিক্ষিত জনগণ চাঁদা দেয় না, তারা প্রতিবাদ করে। তারা ভয় পায় এমন সমাজকে, যারা রাইফেলের চেয়ে কলমকে বেশি বিশ্বাস করে।

একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, একটি বারুদের স্তূপ:

রাবিপ্রবি এখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং একটি বারুদের স্তূপ—যার একপাশে শিক্ষার্থীর ভয়, অন্যপাশে অস্ত্রধারীর দম্ভ। রাষ্ট্র যদি এখনই দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেয়, তবে এই আগুন ছড়িয়ে পড়বে আশেপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও।

পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই অনিরাপদ হয়, তাহলে উন্নয়নের সকল প্রচেষ্টা শুধু কাগজেই রয়ে যাবে। এটা এখন আর স্থানীয় কোনো সমস্যা নয়—এটা জাতীয় সংকট।

আজকের রাতের অন্ধকার যদি আগামী দিনের রক্তাক্ত সকাল হয়ে ওঠে, তার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারবে না। এখনই সময়—অস্ত্রের মুখে নয়, আইনের শাসনে পাহাড়ে শিক্ষা, শান্তি ও সভ্যতার পতাকা উড়ানো। নতুবা ইতিহাস আবারো লিখবে—বাংলাদেশের এক টুকরো পাহাড়, যেখানে শিক্ষা হেরে গিয়েছিল সন্ত্রাসের কাছে।

আগের পোস্টরাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সশস্ত্র টহল, নিরাপত্তা নিয়ে তীব্র উদ্বেগ।
পরের পোস্টসেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বম জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন: শান্তির পথে দৃঢ় পদক্ষেপ

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন