অন্তত অসীম | রাঙামাটি
বাংলাদেশ রাষ্ট্রে উগ্র জাতীয়তাবাদের কোনো আনুষ্ঠানিক বা সাংগঠনিক অবস্থান নেই। বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রনীতি সকল নাগরিকের জন্য সমানাধিকার, মর্যাদা ও মানবিক মর্যাদাবোধকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখানে বাঙালি ও উপজাতি—দুই জাতিসত্তার মধ্যে পরিচয়ের ব্যবধান থাকলেও জাতীয়তা শুধুমাত্র বাংলাদেশী রূপেই সংজ্ঞায়িত। অর্থাৎ নাগরিক জাতীয়তা নির্ধারিত হয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের ভিত্তিতে, বাঙালি বা অন্য কোনো জাতিসত্তা হিসেবে নয়।
পরিসংখ্যানে, বাংলাদেশে প্রায় ৯৯% জনগণ বাঙালি, এবং অবশিষ্ট ১%-এরও কম জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইউপিডিএফ এর পক্ষ থেকে ‘বিশেষ স্বায়ত্তশাসন’ ঘোষণার দাবি নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, উস্কানিমূলক ও অবাস্তব। বাংলাদেশ ক্ষুদ্রভূমির রাষ্ট্র, যেখানে স্বায়ত্তশাসন দেয়া রাষ্ট্রিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের সাথে সাংঘর্ষিক।
২০১১ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালিকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। একইসাথে, সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তা ও অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা হয়। এতে দেশের সকল নাগরিককে ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে জাতীয় পরিচয় প্রদান করা হয়। প্রতিবছর ইউপিডিএফ এই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি পালন করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় সোমবার (৩০ জুন) ২০২৫ খ্রি. চুক্তি বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউপিডিএফ সহযোগী সংগঠনসমূহ—পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ এবং গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম—খাগড়াছড়ি পানছড়ি, দীঘিনালা, রাঙামাটি বাঘাইছড়ির সাজেকসহ বিভিন্ন উপজেলায় ‘উগ্র বাঙালি জাতীয়তা’ পরিত্যাগ ও ‘নতুন সংবিধান’ প্রণয়নের দাবিতে গণসমাবেশ করেছে। এই কর্মসূচীতে তাদের প্রধান দাবি ছিল:
– পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’ ঘোষণা।
– স্ব স্ব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি।
– কথিত ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের লড়াই’-এ আপোষহীন অবস্থান।
এই কর্মসূচীর মূল স্লোগান ছিল –“উগ্র বাঙালি জাতীয়তা ছাড়, নতুন সংবিধান প্রণয়ন কর!” যা সুস্পষ্টভাবে একটি রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব প্রতিফলন করে। এ দাবির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনের স্পষ্ট আহ্বান, যা সংবিধানের ৭(ক) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধের শামিল।
সংবিধান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবতা:
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এ অঞ্চলকে উপজাতি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ গঠন, পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন, ঐতিহ্যিক প্রথা, সামাজিক রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার আইনগত নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে উপজাতি জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, কৃষি, সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর প্রধান প্রভাব ও কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে, যা আঞ্চলিক শাসন ব্যবস্থাই স্বায়ত্তশাসনের অবিকল।
অতএব, দাবি করা যে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো ধরনের স্বায়ত্তশাসন নেই—তা অত্যন্ত অযৌক্তিক। এটি এমন এক প্রেক্ষাপট তৈরি করছে, যা রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ছত্রছায়ায় উপজাতি জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে আলাদা রাষ্ট্রীয় কাঠামো দাবি করার বিপজ্জনক প্রবণতা।
‘স্ব স্ব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি’ দাবি কতটা যৌক্তিক?
সরকারি হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশে ৫০টির বেশি উপজাতি জনগোষ্ঠী আছে। সংবিধান এদের ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে এই পরিচয় প্রচলিত। উপজাতিদের বেঁচে থাকার কবজ পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি তারই উদাহরণ। এখন যদি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, লুসাই, খিয়াং, পাংখোয়া, সাঁওতাল, হাজং, গারো ইত্যাদি সকলকে আলাদা আলাদা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়, তাহলে প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও জাতিগত বিভাজন সৃষ্টির আশঙ্কা প্রবল।
কারণ, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সত্ত্বেও সংবিধানিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক বাস্তবে এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর আলাদা স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। যেমন, বাংলাদেশ সরকারের নথিপত্রে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, হাজং—সবাই তাদের স্বকীয় পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত। কাজেই ‘সংবিধানিক স্বীকৃতি’ নামে ইউপিডিএফ এর দাবি মূলত রাজনৈতিক প্রচারণা ও প্রশাসনিক উস্কানি। এছাড়াও এখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো সমন্বিতভাবে নিজেদের উপজাতি বা পাহাড়ি হিসাবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
ইউপিডিএফ এর দাবির অন্তর্নিহিত সংকট:
গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইউপিডিএফ এর এসব দাবি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের সকল উপজাতি জনগোষ্ঠীর দাবি নয়। উদাহরণস্বরূপ, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি রাজনীতিতে বর্তমানে জেএসএস, জেএসএস সংস্কার, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি), কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং ইউপিডিএফ মূলধারা ছয়টি সংগঠন রয়েছে। এদের মধ্যে দর্শন, লক্ষ্য ও কৌশলগত অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন।
জেএসএস চুক্তিকে উপজাতি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার মূল ভিত্তি মনে করে।
ইউপিডিএফ চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে, বিশেষ স্বায়ত্তশাসন এবং পূর্ণ স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রকারান্তরে স্বাধীনতার অভিপ্রায় লালন করে।
ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), জেএসএস (সংস্কার) ও এমএলপি তুলনামূলকভাবে মডারেট এবং সরকারপন্থী অবস্থান গ্রহণ করেছে।
এই বিভক্তির মধ্যে ইউপিডিএফ এর উগ্র দাবি পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত বিভাজন, সংঘাত, উগ্রতাবাদ ও রাষ্ট্রদ্রোহী মনোভাব উস্কে দেয়। বাস্তবে, ইউপিডিএফ এর অস্তিত্বকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বড় অংশই ভয়ভীতির উৎস ও সহিংসতার প্রতীক হিসেবে দেখে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বরূপ ও সম্ভাব্য পরিণতি:
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও অভিন্ন নাগরিকত্ব নীতি বিশ্বের যে কোনো রাষ্ট্রের মতই অবিচ্ছেদ্য। ইউপিডিএফ এর দাবি বাস্তবায়িত হলে তা রাষ্ট্রিক সংহতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নীতির পরিপন্থী। কেননা, পার্বত্য চট্টগ্রামকে যদি বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তবে বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীও এমন দাবি তুলতে পারে। এর ফলে রাষ্ট্র কাঠামো দুর্বল হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পার্বত্য মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ, ভূমি কমিশন সহ নানা প্রশাসনিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, যা এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত করেছে। তবে ইউপিডিএফ এর উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগান ও অযৌক্তিক দাবি এই অঞ্চলের শান্তি, উন্নয়ন ও পারস্পরিক সহাবস্থানের অন্তরায়।
এটি রাষ্ট্র ও সমাজকে ভাবতে হবে, কেন এই ধরনের উগ্রতার জন্ম হচ্ছে, এবং কোন কাঠামোগত ঘাটতি বা রাজনৈতিক দোদুল্যমানতা তা উস্কে দিচ্ছে। সমাধান হতে হবে সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসনিক দক্ষতা, উন্নয়নমূলক রাষ্ট্রনীতি এবং সন্ত্রাস, বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রশ্নে কঠোর নীতি ও কার্যকর সংলাপের সমন্বয়ে।
অন্যথায়, ইউপিডিএফ এর মতো সীমাহীন উগ্রতার অরণ্যে শান্তি ও অখণ্ডতা রক্ষার সংগ্রাম দিন দিন আরও কঠিন হয়ে উঠবে।