রাজধানীর বুকে ‘আদিবাসী’ নামক কলেজ : ইতিহাস, আইন ও রাজনৈতিক কৌশলের এক মন্থন।

0

অনন্ত অসীম 

ঢাকার মিরপুর-১৩ তে অবস্থিত বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ (EIIN-108214) একটি বিতর্কিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যার কলেজ কোড ১০৮২ এবং স্কুল কোড ১৯৭৫। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি “বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট”-এর অধীনে পরিচালিত। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান, বিশেষত ২৩ (ক) অনুচ্ছেদে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, নৃ-সম্প্রদায় ও সম্প্রদায়’ পরিভাষা প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের স্বীকৃত পরিসরে ‘আদিবাসী’ পরিভাষা স্থান পায়নি। এমন বাস্তবতায় রাজধানীর বুকে আদিবাসী নাম ধারণের অনুমোদন কীভাবে মিলল – প্রশ্ন তুলছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ।

প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও সম্প্রসারণ নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে:

বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যাপকের শূন্যপদে নিয়োগ চলছে। যেমন, ইতিহাসে প্রভাষক। এছাড়া জীববিজ্ঞান, চারু ও কারুকলা, আর্ট, আয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রিসিপশনিস্ট, চেয়ারম্যান সেক্রেটারী ইত্যাদি পদে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে গত ১ জুলাই। ফলে স্পষ্ট, প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার প্রসার ও কর্মসংস্থানে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

১৯৪৭ পরবর্তী পাকিস্তানী শাসন ও ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের সংবিধানেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীকে উপজাতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিতেও ‘উপজাতি’ পরিভাষা ব্যবহারিত। অথচ আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষত ILO Convention 169 এবং UNDRIP (United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples) অনুযায়ী, ‘আদিবাসী’ বলতে এমন জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়, যারা কোনো রাষ্ট্রের সভ্যতার পূর্বাবধি প্রাচীন জনগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করে আসছে এবং সমসাময়িক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতায় সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক অবস্থানে বিদ্যমান (পার্বত্য আদিবাসী দাবিদাররা স্যুট বা ব্লেজারের সাথে কোট টাই পরা)। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে দেখা যায়, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জনগোষ্ঠী বার্মা, ভারত—আসাম, ত্রিপুরা, মঙ্গোলীয়, তিব্বত, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে ১৬৬০-১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে পর্যায়ক্রমে সমতলে এবং পার্বত্য এলাকায় আগমন করে। মুঘল ও ব্রিটিশ দলিলেই তাদের অভিবাসী (Settlers হিল ম্যানুয়েল ৫২) হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। কাজেই আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে আদিবাসী নয়, বরং ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ পরিভাষা যথোপযুক্ত।

রাজনৈতিক কৌশল : আদিবাসী অভিধার প্রচার:

পার্বত্য চুক্তির পরবর্তী সময়ে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীসমূহ, যেমন শান্তি বাহিনী জেএসএস, ইউপিডিএফ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংহতি ও সমর্থন অর্জনের লক্ষ্যে ‘আদিবাসী’ পরিভাষার ব্যবহার শুরু করে। কারণ, ‘উপজাতি’ শব্দে রাষ্ট্রিক অধীনতা ও অভিবাসী চিত্র স্পষ্ট হয়, যেখানে ‘আদিবাসী’ অভিধা ব্যবহারে ভূমিপুত্র দাবি সহজ হয়। এভাবেই রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকাতেই স্কুল-কলেজ, এনজিও, ট্রাস্ট, উন্নয়ন সংস্থার নামকরণে আদিবাসী পরিভাষা প্রচার ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হচ্ছে। ফলস্বরূপ, এরা নিজেদের আন্তর্জাতিক আইনে সংজ্ঞায়িত আদিবাসী হিসেবে প্রমাণের মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী পরিচয় রাজনীতিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করছে।

সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা:

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩ (ক) ধারা, ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংযুক্ত, যেখানে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, নৃ-সম্প্রদায় ও সম্প্রদায়’ পরিভাষা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রথম ও দ্বিতীয় জনগণনা রিপোর্ট, পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল, এফ.ডি.আর. (Federally Defined Races) এবং ব্রিটিশ ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ারেও তাদের উপজাতি ও পার্বত্য অভিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও আদিবাসী নামের এই প্রতিষ্ঠান কেবল ভাষিক বিভ্রান্তি নয়, বরং রাষ্ট্রবিরোধী এজেন্ডার সূক্ষ্ম অংশ বলেই মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকগণ।

আদিবাসী শব্দের সাংবিধানিক সম্ভাব্যতা:

প্রশ্ন থেকে যায়, এই কলেজটির আদিবাসী নাম সংবলিত অনুমোদন কি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, নাকি ট্রাস্ট আইন অনুসারে নিবন্ধিত হয়েছে? তাদের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় কি সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষা নীতির পরিভাষাগত নীতি পরিপালিত হয়েছে? নাকি এটি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পুষ্ট একটি নীতি-লঙ্ঘন?

রাজধানীর বুকে বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। EIIN-108214 নথিভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটি মানবিক-বিজ্ঞান-বাণিজ্য শাখা সহ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও শিক্ষার বিস্তার ঘটাচ্ছে। তবে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার, আন্তর্জাতিক আইনের বিপরীতে অভিবাসন ইতিহাস, পার্বত্য চুক্তি ও সংবিধান থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক অভিধার প্রচার – এই বিষয়ে প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতি হিসেবে আমাদের অধিক সতর্কতা প্রয়োজন। কারণ, পরিভাষার ভ্রান্তি কেবল ভাষার বিষয় নয়; এটি ভূ-রাজনীতি, নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সংবিধান রক্ষার বিষয়ও বটে।

আগের পোস্টবান্দরবানে সেনা অভিযানে কমান্ডারসহ দুই কেএনএফ নিহত।
পরের পোস্টখাগড়াছড়ি জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তন।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন