খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে সম্প্রতি এক নাটকীয় পটপরিবর্তনের সাক্ষী হলো জনপদ। পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরাকে দুর্নীতি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগে অপসারিত করে শেফালিকা ত্রিপুরাকে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৭ ও ৮ জুলাইয়ের নির্দেশপত্রে পরিষদের ১৪ সদস্যের সর্বসম্মত সুপারিশে এই ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়। তবে এর অন্তরালে বিদ্যমান কুটিল ক্ষমতাকামিতা, সম্প্রদায়গত পক্ষপাত, এবং প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য অনস্বীকার্য।
দীর্ঘদিন ধরেই পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ উপজাতি নেতৃত্বের একচ্ছত্র আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এখানে বাঙালিদের জন্য চেয়ারম্যান পদ আইনত নিষিদ্ধ। ১৯৮৯ সালের জেলা পরিষদ আইন ও ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি উপজাতিবাদকে সুদৃঢ় করে এমন বৈষম্য আরোপ করেছে, যা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সমতার নীতিকে চরমভাবে লঙ্ঘন করে। ফলে, পরিষদের আর্থসামাজিক কর্মপ্রয়াস, শিক্ষা ও অবকাঠামোগত বরাদ্দ, চাকুরি ও সুযোগসুবিধা বণ্টনে বাঙালি জনগোষ্ঠী সর্বদাই বঞ্চিত ও অবহেলিত।
জিরুনা ত্রিপুরার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোও কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অব্যাহতভাবে অর্থ আত্মসাৎ, প্রকল্প বণ্টনে স্বজনপ্রীতি, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগে উপজাতীয় একাধিপত্য প্রভৃতি অভিযোগ বারবার উঠেছে। সরকারি বরাদ্দের অর্থ উপজাতি নেতৃবর্গ ও তাদের নিকটবৃত্তদের মধ্যে ভাগাভাগি হওয়ার কারণে, বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলো প্রায় অন্ধকারেই রয়ে গেছে। গ্রামীণ রাস্তা, বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পানীয়জলের ব্যবস্থা – সবকিছুতেই উপজাতি প্রধান অঞ্চলগুলোর প্রাধান্য।
বাঙালি সদস্যদের পক্ষ থেকে পরিষদের এই বৈষম্যপূর্ণ চরিত্র নিয়ে বারবার আপত্তি তোলা হলেও উপজাতি-অধিপতি প্রশাসন তাদের কণ্ঠ রোধে সচেষ্ট। স্থানীয় বাঙালিদের ভাষায়, ‘‘আমরা এখানকার জনগোষ্ঠী হলেও পরিষদে আমাদের কোনও অধিকার নেই।’’ এমন শোষণ, বঞ্চনা এবং বৈষম্য নাগরিক সমাজকে গভীর হতাশা, ক্ষোভ ও বেদনার অতল তলে নিক্ষেপ করেছে।
অন্যদিকে, উপজাতি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে স্বাভাবিকভাবেই গোঁড়ামূলক জাতিগত একত্ববাদ বজায় রাখার জন্য বাঙালিদের এই অভিযোগগুলোকে বারবার ‘জাতিগত আধিপত্যের ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসন, পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, মন্ত্রণালয় – সর্বত্রই উপজাতীয় একাধিপত্য, বাঙালি নিষেধাজ্ঞা ও সিস্টেমেটিক বঞ্চনা বিদ্যমান।
দুর্নীতি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগে জিরুনা ত্রিপুরার অপসারণ শুধুমাত্র ব্যক্তি পরিবর্তন। এতে কাঠামোগত বৈষম্যের অবসান হবে না। শেফালিকা ত্রিপুরাও একই সম্প্রদায়ের, একই ক্ষমতাকাঠামোর ধারক। ফলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা এটিকে ‘ভিত্তির পরিবর্তন নয়, কেবল মুখোশ পরিবর্তন’ হিসেবে দেখছে। তারা মনে করছে, চেয়ারম্যান পদে সকল জাতিগোষ্ঠীর সমান অধিকার না ফিরলে, এই পরিষদ উপজাতিবাদী বঞ্চনা, শোষণ ও লুণ্ঠনেরই প্রতীক হয়ে থাকবে।
জাতীয় সংহতি ও সমতার জন্য ১৯৮৯ সালের জেলা পরিষদ আইন সংশোধন এখন সময়ের অনিবার্য দাবি। উপজাতি স্বার্থরক্ষার আড়ালে রাষ্ট্রের এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে দুর্বিষহ সামাজিক বর্জন ও আত্মসম্মানহানির প্রতীক হয়ে উঠেছে। কোনও সভ্য সমাজেই এমন আইন টিকে থাকতে পারে না, যেখানে জনসংখ্যার বৃহৎ অংশকে চিরতরে নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়।
অতএব, রাষ্ট্র যদি চায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মধ্যে সত্যিকারের সহাবস্থান, সম্প্রীতি ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, তবে এই উপজাতিবাদী প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যকে নির্মূল করতে হবে। পার্বত্য জেলা পরিষদ বাঙালি ও উপজাতি উভয়ের করদানে চলে, অথচ এর নেতৃত্ব ও সুবিধা একতরফা – এই সাংঘর্ষিক বাস্তবতা রাষ্ট্রকে একদিন ভয়ঙ্কর সামাজিক সংকটে নিমজ্জিত করবে। এখনই প্রয়োজন জাতিগত ন্যায়, আর্থসামাজিক সাম্য এবং নেতৃত্বে অংশীদারিত্বের বিধান।



