খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের এক অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীকে কেন্দ্র করে গণধর্ষণের অভিযোগ এবং মানিকছড়িতে মাদরাসাছাত্র মো: সোহেল (১৪) এর অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের দাবি, মাদরাসাছাত্র হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দিতে একটি বিশেষ মহল পরিকল্পিতভাবে গণধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়ে পার্বত্য অঞ্চলে অশান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করছে।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ:
শনিবার (১৯ জুলাই ২০২৫) খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন খাগড়াছড়ি জেলার সভাপতি মোশাররফ হোসেন লিখিত বক্তব্যে বলেন, ভাইবোনছড়ার ঘটনাটি একটি প্রেমঘটিত ব্যক্তিগত বিষয়, যাকে ‘গণধর্ষণ’ হিসেবে প্রচার করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা চলছে। তিনি দাবি করেন, মেয়েটি তার স্বজাতির এক যুবকের সাথে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের সম্পর্কে ছিল। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সে বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ১২ জুলাই তাকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ১৪ জুলাই ছাড়পত্র পায়। পরে ১৬ জুলাই আবারো বিষপানের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়। ওই দিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ছড়ানো হয়।
মোশাররফ হোসেন প্রশ্ন তুলে বলেন, “২৭ জুন রাতে কথিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও ২০ দিন পর ১৭ জুলাই কেন মামলা দায়ের করা হলো? মেয়েটির পরিবার বা স্থানীয় সংগঠনগুলো তৎক্ষণাৎ আইনের আশ্রয় নিল না কেন? মূল অভিযুক্ত প্রেমিককে কেন মামলায় আসামি করা হলো না?” তিনি অভিযোগ করেন, একটি সশস্ত্র উপজাতীয় গোষ্ঠী এই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে অশান্তি ও জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
মাদরাসাছাত্র হত্যাকাণ্ড:
মোশাররফ হোসেন জানান, গত ৪ জুলাই মানিকছড়ির ছদরখীল এলাকায় মাদরাসাছাত্র মো: সোহেলকে একটি সশস্ত্র চাঁদাবাজ গ্রুপ অপহরণ করে। পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হলেও তা না পেয়ে ১৬ জুলাই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বাটনাতলী ইউনিয়নের বুদুংপাড়ার একটি ছড়ায় ফেলে রাখা হয়। তার হাত, পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি এই হত্যাকাণ্ডকে মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ আখ্যা দিয়ে সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। এসময় জেলা সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদ উল্লাসসহ নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
ধর্ষণ মামলার বিবরণ:
গত ২৭ জুন ভাইবোনছড়ায় অষ্টম শ্রেণির এক ত্রিপুরা ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে ১৬ জুলাই তার বাবা খাগড়াছড়ি সদর থানায় ছয়জনের নামে মামলা দায়ের করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, রথযাত্রা উৎসবের পর মেয়েটি তার চাচার ভাড়া বাসায় রাত কাটাতে গেলে চাচাকে আটকে রেখে তাকে ধর্ষণ করা হয়। ওই রাতেই পুলিশ অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে, যারা হলেন আরমান হোসেন (৩২), ইমন হোসেন (২৫), এনায়েত হোসেন (৩৫) ও সাদ্দাম হোসেন (৩২)। বাকি দুই আসামি পলাতক।
- সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন নিম্নলিখিত দাবি উত্থাপন করে:
– ভাইবোনছড়ার ধর্ষণ অভিযোগের নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত।
– মো: সোহেল হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনা।
– পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা।
– অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ।
বিক্ষোভ ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা:
১৭ জুলাই থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৮ জুলাই শিক্ষার্থী ও সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনগুলো খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল করে। এতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন অংশ নেয়। তবে সমঅধিকার আন্দোলনের দাবি, এই প্রচারণা পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের অংশ।
উল্লেখ্য যে: মো: সোহেলের অপহরণের ঘটনায় ১১ জুলাই তার নানা আবদুর রহিম প্রকাশ গফুর আনসার পাঁচজনের নামে অপহরণ মামলা দায়ের করেন। যৌথবাহিনীর অভিযানে তিনজনকে আটক করা হয়। ১৬ জুলাই তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এই দুটি ঘটনা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এই ঘটনাগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের সংবেদনশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। ধর্ষণ অভিযোগ এবং হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় প্রশাসনের সতর্ক ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।