খাগড়াছড়ির বুকে আবারও এক হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম। মানিকছড়ির নিস্পাপ মাদ্রাসাছাত্র মোঃ সোহেলকে (শ্রেণি: সপ্তম) অপহরণের পর হত্যা করা হয়। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকালে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নিহত সোহেলের জননীর আর্তনাদ আকাশকেও কাঁদিয়েছে।
সকালেই খাগড়াছড়ি শাপলা চত্বর থেকে শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল। পরিবারবর্গ ও এলাকাবাসীর ব্যানারে মিছিল আদালত চত্ত্বরে গিয়ে মানববন্ধনে পরিণত হয়। মঞ্চে উঠে কথাগুলো বলার সময় সোহেলের মা রাবেয়া আক্তার বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলছিলেন –
“একটি সন্তানই ছিল, তাও কেড়ে নিলো। আল্লাহর বিচার আছে। আমি এই হত্যার বিচার চাই।”
এসময় বক্তব্য রাখেন পাড়া কার্বারী অংসাজাই মারমা, আব্রে মারমা, নানা আবদুর রহিম, গ্রাম সর্দার মোসলেম উদ্দিন, ছাত্রনেতা মো. সাকিব এবং আরও অনেকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির ও জেলা সাধারণ সম্পাদক এস এম মাসুম রানাও বক্তৃতা দেন। বক্তাগণ প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, কারণ ইতিমধ্যেই ৭ জনকে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।
৪ জুলাই রাতে মানিকছড়ির ছদুরখীল বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হয় সোহেল। অজ্ঞাত অপহরণকারীরা ফোন করে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের পর গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যে ১৬ জুলাই সোহেলের নিথর দেহ উদ্ধার হয়। একটি পরিবারের আলো নিভে যায়।
স্থানীয় বাঙালিরা জানান, পার্বত্য চুক্তির পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে প্রায় ৩৮ হাজার বাঙালি উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন, কিন্তু বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি সন্ত্রাসকে আরও বেপরোয়া করেছে। পাহাড়ে শুধু বাঙালিরাই নয়, অনেক নিরীহ উপজাতি ব্যক্তিরাও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে প্রাণ হারাচ্ছেন। মানবতার রঙ কখনো একপক্ষীয় হয় না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করা বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ভাইবোনছড়ায় একটি কথিত ধর্ষণ ইস্যুতে যে তীব্র প্রতিবাদ, সংবাদ সম্মেলন এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হয়েছে, সেই একইভাবে সোহেল হত্যার ঘটনায় হয়নি। এখানে জাতিগত পক্ষাবলম্বন স্পষ্ট। একটি হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইলে তা নিছক কোনো সম্প্রদায়ের অধিকার নয়, এটি মানবতার ন্যূনতম দাবি।
সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি প্রশ্ন—
পাহাড়ে কি বাঙালিরা নিরাপদ?
হত্যাকারীদের দ্রুত শাস্তি হবে তো?
সকল সম্প্রদায়ের জন্য সমান আইন প্রয়োগ হবে তো?
এই প্রশ্নগুলো বারবার ভেসে আসে শাপলা চত্বর থেকে আদালত চত্বর পর্যন্ত প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখে।
যে মাদ্রাসা ছাত্র সোহেলের মুখের হাসিতে তার মায়ের জীবনের সব সুখ নিহিত ছিল, সেই মুখ চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তার মায়ের চোখের জল কি বিচারপ্রার্থীদের বিবেককে জাগাবে?
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সূর্যোদয় ঘটুক। সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যে জাতিরই হোক, তাদের জন্য কোনো মমতা নেই। আর সোহেলদের যেন হত্যা না হতে হয়, সেই দায় আমাদের সবার।