বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সংবিধান যে অধিকার নিশ্চিত করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো নিজ এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার, জমি ক্রয়-বিক্রয়, শিক্ষা ও চাকরিতে অংশগ্রহণের সুযোগ। কিন্তু বান্দরবান পার্বত্য জেলার একটি সনদপত্র, যাকে বলা হয় স্থানীয় বাসিন্দা (ডিসি) সনদ, সেটি পেতে যে শর্তগুলোর মুখোমুখি হতে হয়—তা দেখে প্রশ্ন জাগে: একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকারের পেছনে কী জাতি, গোত্র, কিংবা ভূগোল নির্ধারণ করে দেয়?
বান্দরবান জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে দেওয়া একটি চার পৃষ্ঠার নির্দেশনাতে দেখা যায়, ডিসি সনদ পাওয়ার জন্য আবেদনকারীকে পেশ করতে হবে: ভোটার আইডি, জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ইউনিয়ন পরিষদের সনদ,, হেডম্যান রিপোর্ট, সার্কেল চীপ সনদ, বাসিন্দা প্রমাণ, জমির কাগজপত্র, সনদের প্রয়োজনীয়তা কেন, এমনকি আবেদনকারীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রমাণ, এবং সাক্ষীসহ একটি জবানবন্দি!
প্রশ্ন হলো—একজন নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, জন্মনিবন্ধন এবং ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত নাগরিক সনদ থাকার পরও কেন তাকে অতিরিক্ত ১৫-২০টি কাগজ সংগ্রহ করতে হবে, কেবলমাত্র ডিসি সনদের জন্য? এমনকি জমি না থাকলে উপজাতিদের ক্ষেত্রে হেডম্যান কিংবা চেয়ারম্যানের সুপারিশেই সনদ দেওয়া হলেও, বাঙালিদের জন্য রয়েছে কঠোর ও দুর্বোধ্য প্রক্রিয়া।
এখানেই দেখা যায় সুস্পষ্ট বৈষম্যমূলক নীতি। যেখানে দেশের ৬১টি জেলায় স্থানীয় বাসিন্দা সনদের কোনো প্রয়োজন নেই, সেখানে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে এক টুকরো জমি কিনতে গেলে বা বিক্রি করতে গেলে ডিসি সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালিরা।
স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন হাস্যকর ও বিভ্রান্তিকর শর্তাবলি রাখা হয়েছে বাঙালি হয়রানির জন্য৷ এমনকি সাধারণ উপজাতিরাও এই ধরনের শর্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
বান্দরবান পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা সনদ প্রাপ্তির গাইডলাইন—
ক) আবেদনকারীকে ০২ কপি আবেদনপত্র পুরণ করে নিম্নোক্ত কাগজপত্রাদি ও ফটোকপি সংযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে দাখিল করতে হবে। আবেদনকারী কর্তৃক সংযুক্ত ফটোকপি সমুহের মূল সার্টিফিকেট প্রদর্শন সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী অফিসার সংযুক্ত ফটোকপি সমূহ সত্যায়ন করিবেন এবং আবেদনকারী মূল সার্টিফিকেট প্রদর্শন করেছেন এই মর্মে উপজেলা নির্বাহী অফিসার একটি প্রত্যয়নপত্র অগ্রায়ন পত্রের সাথে সংযুক্ত করবেন।
- ১। আবেনকারীর পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি-০২ কপি।
- ২। আবেদনকারীর নিজ (যদি থাকে) পিতা, মাতার জাতীয় পরিচয়ত্র।
- ৩। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ।
- ৪। জন্মনিবন্ধন সনদ।
- ৫। বোমাং সার্কেল চিফ কর্তৃক প্রদত্ত সনদ।
- ৬। হেডম্যান কর্তৃক প্রদত্ত স্থায়ী বাসিন্দা সনদ।
- ৭। ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর মেয়র কর্তৃক ইস্যুকৃত জাতীয়তা সনদ।
- ৮। মাতা/পিতা/মাতামহ/পিতামহ/নিজ নামীয় জমির জমাবন্দী।
- ৯। পিতামহ/মাতামহের নামে জমি থাকলে, পিতামহ/মাতামহ জীবিত হলে পিতামহ/মাতামহের এনআইডি এর সত্যায়িত কপি সংযুক্ত করতে হবে।
- পিতামহ/মাতামহ মৃত হলে জেলাপ্রশাসক বা সংশ্লিষ্ট পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত ওয়ারিশ সনদের সত্যায়িত ফটোকপি সংযুক্ত করতে হবে।
- ১০। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, রেকর্ডীয় জমি না থাকলে হেডম্যান ও মেয়র/চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত আবেদনকারী ভূমিহীন এই মর্মে আলাদা প্রত্যয়ন পত্র।
- ১১। আবেদনপত্রে সংযুক্ত জমাবন্দীতে রেকর্ডীয় প্রজার নাম এনআইডি কার্ডে উল্লিখিত নামের সাথে মিল না থাকলে, উভয়ে একই ব্যক্তি এই মর্মে সংশ্লিষ্ট পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্রের কপি সংযুক্ত করতে হবে।
- ১২। যে কারণে স্থায়ী বাসিন্দা সনদ প্রয়োজন তার প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির ফটোকপি।
- খ)
৫) ফরমে চাহিত প্রতিটি তথ্য নির্ভুলভাবে ও কাটাছেড়া ব্যতিরেকে স্বহস্তে পূরণীয়। - চ) আবেদনের সাথে ২০/- টাকার কোট ফি সংযুক্ত করতে হবে।
- ছ) শুনানীতে ২০/- টাকার কোর্ট ফি সংযুক্ত কতে হবে।
- ঞ) প্রস্তুতকৃত সনদপত্র শিক্ষা ও কল্যান শাখা, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বান্দরবান পার্বত্য জেলা থেকে গ্রহণ করতে হবে।
এই প্রক্রিয়াকে একটি সাধারণ সনদপ্রাপ্তি নয়, বরং দুর্বিষহ প্রশাসনিক এক যুদ্ধ বলা চলে। অনেক আবেদনকারী জানান, অসাংবিধানিক হেডম্যান রিপোর্টের জন্য ১০-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় এবং তা দালালদের মাধ্যমে আদায় করা হয়। সার্কেল চীপ সনদ নিতে আবার এই হেডম্যান রিপোর্ট প্রয়োজন। এই বাস্তবতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ডিসি অফিস ও ইউএনও অফিস স্টাফদেরও টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা বলছেন, স্থানীয় বাসিন্দা সনদ পেতে প্রায় একই ধরনের জটিলতা ও বৈষম্য খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান—তিন জেলাতেই বিরাজমান। যদিও খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সীমিতভাবে অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, বান্দরবানে এখনো বিস্ময়করভাবে অনলাইন আবেদনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে বান্দরবানের নাগরিকদের জন্য প্রক্রিয়াটি হয়ে উঠেছে আরও দুর্বিষহ ও হয়রানিমূলক। বাস্তবতা হলো—সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য তিন জেলায় সবচেয়ে বেশি প্রশাসনিক হয়রানির অভিযোগ উঠে এসেছে বান্দরবান থেকেই।
হেডম্যান সনদ-প্রতিবেদন ও সার্কেল চীপ সনদ : অসাংবিধানিক ও বিভাজনমূলক:
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি মৌজা হেডম্যান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অধিকাংশ হেডম্যান উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়েছে। এখানে তিনজন সার্কেল চীপ রয়েছে, যারা উপজাতি চাকমা, মারমা। বাঙালিদের পক্ষে এই সনদ কিংবা জমি বেচা-কেনার হেডম্যান প্রতিবেদন সংগ্রহ করা অত্যন্ত দুরূহ। কেউ কেউ অনৈতিকভাবে টাকা দাবি করেন, কেউ আবার সরাসরি প্রতিবেদন বা সনদ দিতে অস্বীকৃতি জানান। অথচ হেডম্যান ও সার্কেল চীপের মতামতের ভিত্তিতে ডিসি সনদ দেওয়ার বিধান বাংলাদেশ সংবিধানের কোথাও নেই। এটি একটি উপনিবেশিক আমলের অনুশাসনের মতো শৃঙ্খল, যা বর্তমানে সংবিধানের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রশাসনিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ:
জেলা প্রশাসকগণ মনে করেন, স্থানীয় বাসিন্দা সনদ প্রদানের ক্ষমতা তাদের হাতে থাকায় তারা যেকোনো শর্ত আরোপ করতে পারেন। কিন্তু তারা ভুলে যান—পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ এবং পার্বত্য চুক্তি ১৯৯৭ অনুযায়ী এখন ডিসির ঊর্ধ্বে রয়েছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। বর্তমান আইনে খাস ও সরকারি জমি ছাড়া অধিকাংশ জমির প্রশাসনিক ক্ষমতা জেলা পরিষদের অধীন (বেচাকেনার অনুমতি)। অতএব, ডিসিদের উচিত হবে, একতরফাভাবে উপজাতি হেডম্যান ও সার্কেল চীপের ইচ্ছার কাছে নিজেদের সনদপ্রদানের এখতিয়ার বন্ধক না রাখা।
উপজাতি তোষণের নামে বাঙালিদের নিপীড়ন:
এই ব্যবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি-বাঙালি বিভাজনকে আরও ঘনীভূত করছে। স্থানীয়রা বলছেন, মূলত বাঙালিদের পার্বত্য এলাকা থেকে উচ্ছেদ করে, শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতেই এই জটিলতা তৈরি করা হয়েছে। যারা একটি সনদপত্র তুলতে গিয়ে জুতোর তলা ক্ষয় করে ফেলছেন, তাদের জন্য এটা নিছক হয়রানি নয়—এটা রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার দৃষ্টান্ত।
সমাধানের পথ কী? সরকারের উচিত হবে:
১. জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ও ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিক সনদের ভিত্তিতেই স্থানীয় বাসিন্দা সনদ প্রদান করা কিংবা পূর্বের মত জমির জবানবন্দি, বসত ঘর রয়েছে, ভূমিহীন যাচাই-বাছাই করে প্রদান করা। ২. হেডম্যান রিপোর্ট ও সার্কেল চীপ সনদ বাধ্যতামূলক না রেখে ঐচ্ছিক করা কিংবা সম্পন্ন বাতিল করা। ৩. আবেদন প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল এবং দুর্নীতিমুক্ত করা। ৪. পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল নাগরিকের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করা।
একটি রাষ্ট্র, যখন তার জনগণের ভেতরে বিভাজনের নীতি প্রয়োগ করে, তখন সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাসিন্দা নির্ধারণে বৈষম্যমূলক ডিসি সনদ সেই দুর্বল ভিত্তিরই প্রতিচ্ছবি। এখনই যদি সংশোধন না করা হয়, তবে জাতিগত সম্প্রীতির বদলে বিভাজনই হবে এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অংশ।