গায়ের চামড়া তুলে হত্যা, ১৯ বছর পর জেএসএসের বিরুদ্ধে রায়।

0

অন্তত অসীম | রাঙামাটি

রাঙামাটি, ৬ আগস্ট ২০২৫ (মঙ্গলবার):
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষে রাঙামাটির জেলা জজ আদালত এক নজিরবিহীন রায় ঘোষণা করেছে। ২০০৬ সালের ১ ডিসেম্বর বর্বরোচিতভাবে হত্যাকৃত কিনা মোহন চাকমা হত্যা মামলায় (বুধবার) ৬ আগস্ট আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর তিন সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছেন আদালত। এসি মামলা নং-১৫/১২-এর আলোকে ১১ আসামির মধ্যে ৮ জন খালাস পেলেও প্রথমবারের মতো জেএসএস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এমন দৃষ্টান্তমূলক সাজা প্রত্যক্ষ করলো পাহাড়বাসী।

কিনা মোহন চাকমা ছিলেন রাঙামাটির দুর্গম জুরাছড়ি উপজেলার একজন সম্মানিত ব্যক্তি এবং উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রূপ কুমার চাকমার পিতা। তিনি ১৯৮৫ সালে জেএসএসের সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী ত্যাগ করেন। কারণ ছিল— সংগঠনের বেড়ে চলা চাঁদাবাজি, সহিংসতা, দমন-পীড়ন ও সাধারণ মানুষের উপর দুঃশাসন। এছাড়াও একপাক্ষিক আধিপত্য নয়, তিনি পাহাড়ি ও বাঙালির পারস্পরিক সম্মান ও সমঅধিকারকে শান্তির মূল শর্ত বলে বিশ্বাস করতেন। এই দর্শন থেকেই তিনি গড়ে তোলেন “সচেতন নাগরিক কমিটি”—একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফর্ম, যা দ্রুতই জনপ্রিয়তা অর্জন করে জুরাছড়িসহ আশপাশের অঞ্চলে। জনগণের চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নির্ভরতার প্রতীক; কিন্তু আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে তিনি ছিলেন হুমকি। তাঁর জনপ্রিয়তাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে নির্মম মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
শান্তিবাহিনীর তৎকালীন কমান্ডার সত্যবাদী দেওয়ানের ক্ষোভের শিকার হন তিনি। তার নির্দেশেই ২০০৬ সালের ১ ডিসেম্বর অপহরণ করে নির্জন স্থানে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কিনা মোহন চাকমাকে।

নৃশংসতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া বর্বরতা:

অপহরণের পর নির্জন বনে নিয়ে গাছের সাথে বেঁধে তাঁর গায়ের চামড়া তুলে ফেলা হয়, মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করা হয়, এবং তাঁর দুই হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। স্থানীয়দের মতে, গাছের গায়ে পেরেকও মারা হয়েছিল তাঁর দেহের সঙ্গে। এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম স্তব্ধ হয়ে যায়। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পাহাড়ে মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভ ফেটে পড়ে। অনেকে এই ঘটনাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে আখ্যা দেন।

ছেলের প্রতিবাদ—ভয়ার্ত পাহাড়ে সাহসী কণ্ঠ:

বাবার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন রূপ কুমার চাকমা। তিনি ২০১৭ সালের ১৪ মে রাঙামাটি জিমনেসিয়াম মাঠে আয়োজিত মহাসমাবেশে জেএসএসের বিরুদ্ধে সোচ্চার বক্তব্য দিয়ে বলেন,
“যদি বাহুতে শক্তি থাকে, তবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সামনে এসো, সাধারণ নিরীহ মানুষের রক্ত কেন?”
তাঁর এই প্রতিবাদী বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, যা পাহাড়ের জনগণের অন্তরে সাহস জোগায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি ২০২০ সালের ৬ মে কিডনি ও পিত্তথলির জটিলতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

অবশেষে তিন জেএসএস সদস্যের যাবজ্জীবন:

বহুল আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন রাঙামাটি জেলা জজ আদালত। দীর্ঘ প্রায় ১৯ বছর পর বিচার প্রক্রিয়ার শেষ হলো—যেখানে রাষ্ট্রীয় অবহেলা, প্রমাণ সংগ্রহে ব্যর্থতা ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার কারণে অনেক পাহাড়ি হত্যাকাণ্ডই অন্ধকারেই থেকে গেছে। এই মামলার ফাইল, নথিপত্র ও সাক্ষ্য প্রমাণ গায়েব এবং বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র চলমান ছিল। তবুও এই রায়ে পাহাড়ের নির্যাতিত মানুষের এক দীর্ঘশ্বাস কিছুটা প্রশমিত হলো।

নিষ্প্রভ রাষ্ট্র, সক্রিয় সন্ত্রাস—এটাই পার্বত্য চট্টগ্রাম:

পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস ও অন্যান্য আঞ্চলিক গ্রুপের বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, অপহরণ, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজির একাধিক মামলা থাকলেও পুলিশের অবহেলায় অধিকাংশই প্রমাণ ও তদন্তের অভাবে ধামাচাপা পড়ে গেছে। কিনা মোহন চাকমা হত্যা মামলায় রায় হওয়া সেই অর্থে প্রথম একটি ‘পলিটিক্যাল কিলিং’-এর বিচার, যা রাষ্ট্রের জন্য এক বড় অগ্নিপরীক্ষা ছিল।

মানবিক প্রশ্ন—আজও কাঁদে পাহাড়:

আদালত তিন আসামি—সুবল চন্দ্র ওরফে সুকৃতি চাকমা, হৃদয় কুমার চাকমা ও বুদ্ধমনি চাকমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে বাকি আটজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তবে কাউকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। এমন রায়ে কিনা মোহন চাকমার পরিবারের সদস্যরা সন্তুষ্ট কি না, তা জানা যায়নি। যেভাবে একজন প্রবীণ নাগরিককে তাঁর প্রাক্তন সংগঠন জেএসএস পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করে শরীরের চামড়া তুলে পেরেক মারা হয়, তা শুধু পাহাড় নয়, সমগ্র জাতিকেই স্তম্ভিত করে দেয়। এটি কোনো রাজনৈতিক সহিংসতা নয়, এটি একটি মানবতা বিরোধী অপরাধ।

এই রায় শুধু বিচার নয়, এটি একটি বার্তা—সন্ত্রাস যতই পাহাড়ের পেছনে লুকাক, একদিন তাদের মুখোশ খুলবেই। কিনা মোহন চাকমার রক্তের দাম এ জাতি মনে রাখবে, এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরীহ মানুষের বাঁচার অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এই রায় হবে অনুপ্রেরণা।

 

আগের পোস্টখাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ-এর সমাবেশে গুলিবর্ষণ, নারী আহত: আতঙ্কে শহর।
পরের পোস্টআদিবাসী স্বীকৃতি পেলে পার্বত্যাঞ্চলে সামরিক কার্যক্রম সঞ্চালিত হবে না।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন