হিলনিউজবিডি প্রতিবেদক
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য “আদিবাসী” শব্দটির সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি দীর্ঘদিন ধরে একটি জ্বলন্ত বিতর্কের বিষয়। এই দাবির বড় সমর্থক উপজাতি সংগঠনগুলো জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র (United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples বা UNDRIP) এর উপর ভর করে তাদের যুক্তি সাজান। ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর গৃহীত এই ঘোষণাপত্রের ৪৬টি ধারার মধ্যে বিশেষ করে ধারা ৩০ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো ভূ-রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, আদিবাসীদের ভূমি বা অঞ্চলে সামরিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে না, যদি না তা জনস্বার্থে ন্যায়সঙ্গত হয় বা আদিবাসীদের সম্মতি না থাকে। এই ব্লগে আমি এই বিষয়টির গভীর বিশ্লেষণ করব এবং ব্যাখ্যা করব কেন এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের জাতীয় অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
UNDRIP ধারা ৩০: সামরিক কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ধারা ৩০-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
১. আদিবাসীদের ভূমি বা অঞ্চলে সামরিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে না, যদি না তা জনস্বার্থে ন্যায়সঙ্গত হয়, বা আদিবাসীদের অবাধ সম্মতি থাকে, অথবা তারা নিজেরাই এটির অনুরোধ না করে।
২. সামরিক কার্যক্রম শুরু করার আগে রাষ্ট্রকে অবশ্যই আদিবাসীদের প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকর পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
এই ধারার প্রভাব বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে বিপজ্জনক। যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সম্প্রদায়কে “আদিবাসী” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে এই অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের সম্মতি আবশ্যক হবে। সম্মতি না থাকলে সেনাবাহিনীকে এই অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করতে হতে পারে। এটি এককেন্দ্রিক রাস্ট্র ব্যবস্থার বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি ভয়াবহ শূন্যতা সৃষ্টি করবে, যা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী শক্তির জন্য পথ প্রশস্ত করতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় এক-দশমাংশ জুড়ে বিস্তৃত। এটি ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে ত্রিদেশীয় সীমান্তে অবস্থিত, যা এটিকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এই অঞ্চলের পাহাড়ি ভূমি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ, সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যেমন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), এবং কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর কার্যক্রম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
১৯৭০-এর দশক থেকে এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরও এখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, কারণ চুক্তি পুরোপুরি সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারেনি। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির অংশ ফলে UNDRIP-এর ধারা ৩০ কার্যকর হয় এবং সেনাবাহিনীকে এই অঞ্চল থেকে সরিয়ে নিতে হয়, তাহলে এটি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করবে।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখছে। সেনা ক্যাম্পগুলো এই অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় নিরাপত্তা প্রদান করে এবং সাধারণ নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ সম্ভব করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, সাজেক ভ্যালি বা রাঙামাটির মতো জনপ্রিয় পর্যটন স্থানে যেতে সেনাবাহিনীর স্কট বা অনুমতি প্রয়োজন। বান্দরবানের রুমা থানচির পর্যটন স্পষ্টে একই অবস্থা। সেনাবাহিনী না থাকলে এই অঞ্চল সন্ত্রাসীদের দখলে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফলে সাধারণ বাঙালি নাগরিকদের জন্য এই অঞ্চল ভ্রমণ অসম্ভব হয়ে পড়বে, এমনকি এটি একটি “নো-ম্যানস ল্যান্ড” বা বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে পরিণত হতে পারে।
UNDRIP-এর ধারা ৩ (আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার), ধারা ৪ (স্বায়ত্তশাসন), এবং ধারা ৬ (জাতীয়তার অধিকার) আদিবাসীদের এমন ক্ষমতা দেয় যা তারা আলাদা জাতীয়তার দাবি তুলতে ব্যবহার করতে পারে। ধারা ১০ (জোরপূর্বক অপসারণের নিষেধ) ব্যবহার করে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে এই অঞ্চল থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা হতে পারে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে “আদিবাসী” অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হবে। এরপর জাতিসংঘের মাধ্যমে গণভোটের আয়োজন করে তারা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্নতার পথ বেছে নিতে পারে।
একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ হলো ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। এই দেশে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আলাদা জাতীয়তার দাবি তুলে দীর্ঘদিন ধরে সংঘাতে জড়িয়ে ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে “আদিবাসী” স্বীকৃতি এই ধরনের একটি পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিদেশীয় সীমান্ত এটিকে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্য একটি কৌশলগত লক্ষ্যে পরিণত করেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যেমন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্ট Therefore, সিল অফ নাগাল্যান্ড (NSCN) বা ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম (ULFA)-এর সঙ্গে এখানকার সন্ত্রাসীদের যোগসূত্রের প্রমাণ রয়েছে। মায়ানমারের আরাকান আর্মির সঙ্গেও এই অঞ্চলের কিছু গোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আদিবাসী স্বীকৃতি এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার জন্য বহিরাগত শক্তির হাতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
২০০৭ সালে UNDRIP গৃহীত হওয়ার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সংগঠনগুলো “আদিবাসী” শব্দটি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে শুরু করে। এই প্রচারণায় এনজিও, খ্রিস্টান মিশনারী গোষ্ঠী, এবং পশ্চিমা কূটনীতিকদের অর্থ ও লজিস্টিক সহায়তার অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে এই শব্দটির ব্যবহার পরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। সম্প্রতি গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহম্মেদের প্রস্তাবনায় “আদিবাসী” শব্দটির অন্তর্ভুক্তি এই প্রক্রিয়ারই একটি অংশ বলে অনেকে মনে করেন। এই ধরনের পদক্ষেপ দেশের অখণ্ডতার জন্য একটি গভীর হুমকি।
একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, ২০১১ সালে বাংলাদেশের জনশুমারিতে “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহারের প্রস্তাব উঠেছিল, যা সরকার প্রত্যাখ্যান করে। তবে এই প্রচারণা থেমে নেই। বিভিন্ন এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে এই বিষয়টি বারবার সামনে আনা হচ্ছে।
কেন বিরোধিতা?
১. জাতীয় অখণ্ডতার প্রশ্ন
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। আদিবাসী স্বীকৃতি এই উপস্থিতিকে দুর্বল করবে এবং দেশের অখণ্ডতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
২. ঐতিহাসিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের “উপজাতি” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। “আদিবাসী” শব্দটি এদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই জনগোষ্ঠী বাংলার আদি বাসিন্দা নয়, বরং বিভিন্ন সময়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মায়ানমার থেকে এখানে এসেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলেও তাদের “ট্রাইবাল” বা “উপজাতি” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
৩. বিচ্ছিন্নতাবাদের ঝুঁকি
UNDRIP-এর ধারা ৩, ৪, ৫, ৬, ১০, ২৫, ২৬, এবং ৩০ একত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ, জাতীয়তা, এবং ভূমি অধিকারের এমন একটি কাঠামো তৈরি করে, যা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে অপব্যবহার হতে পারে। এই ধারাগুলো যদি বাংলাদেশে কার্যকর হয়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি “মিনি-রাষ্ট্র” গঠনের পথ খুলে যেতে পারে। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম যেতে পাসপোর্ট ও ভিসা লাগবে। হয়তো অনেকেরই কাছে কথাটি অবান্তর মনে হতে পারে।
“আদিবাসী” স্বীকৃতি প্রদানের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক কার্যক্রম বন্ধ হবে, যা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য মারাত্মক হুমকি। এটি শুধুমাত্র একটি শব্দের প্রশ্ন নয়, বরং একটি গভীর ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত যে, এই স্বীকৃতি দেশের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করতে পারে। UNDRIP-এর ধারাগুলো ভালোভাবে পড়লে বোঝা যায়, এর পিছনে লুকিয়ে থাকা বিপদ কতটা গভীর। আমি একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে এই স্বীকৃতির বিরোধিতা করছি এবং সবাইকে এই বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।