হেডম্যান প্রতিবেদনের অজুহাতে —আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

0
২৯ জুলাইয়ে চিঠি

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ, যেখানে রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রচলিত ভূমি আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রথাগত ও ঔপনিবেশিক যুগের ধ্বংসাবশেষ—হেডম্যান প্রথা—ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈষম্যমূলক ভূমিকা রেখে চলেছে। বাঙালি ভূমি-ক্রেতা ও মালিকদের জন্য এই প্রথা প্রায়শই একটি প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার গত ২৯ জুলাই ২০২৫ তারিখে একটি চিঠিতে হেডম্যান প্রতিবেদনের বাধ্যতামূলকতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দেন, যা সরাসরি আদালতের রায়কে উপেক্ষা করে এবং সংবিধানবিরোধী বৈষম্যকে প্রমোট করে।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদারের চিঠির হুবহু উদ্ধৃতি:

“মারক নং- ২৯.৩৪.৮৪০০,২০৫.৫১.০০১.২০২৫ ৯৪১
তারিখঃ ২৯/০৭/২০২৫খ্রি.

বিষয়ঃ বিবিধ মামলা (আদালত) পূর্বানুমোদন প্রদান বিষয়ে মতামত।

উপর্যুক্ত বিষয়ে সদয় দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক জানানো যাচ্ছে যে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, রাঙ্গামাটি হতে বিবিধ মামলা (আদালত) রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদনের জন্য বিভিন্ন স্মারকে প্রস্তাব পাওয়া যায়। জমিগুলো পূর্বানুমোদন প্রদানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা উদ্ভত হওয়ায় আপনার সদয় অবগতির জন্য বর্ণিত বিবিধ মামলার বিষয়ে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হলোঃ
১। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২২/১০/২০০৬খ্রি. তারিখের পাচবিম (প-১)-বা-বান/বিবিধ/১২/৯৯/০৩ মূলে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদকে (ক) জমি বিক্রেতার আবেদন, (খ) হেডম্যানের প্রতিবেদন, (গ) কানুনগো/সার্ভেয়ারের প্রতিবেদন, (ঘ) জমাবন্দি (খতিয়ান) এবং (৪) জমির সংক্রান্ত ক্যাচম্যাপ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে সুপারিশসহ কাগজপত্রাদির অনুলিপি পাওয়ার প্রাপ্তির পর মিউটেশন কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারেন বলে মর্মে মন্ত্রণালয় পত্র প্রদান করেন।
২। বর্তমানে সিভিল স্যুট মামলা করে হেডম্যানের নিকট হতে কোন প্রত্যয়ন বা প্রতিবেদন গ্রহণ না করেই বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত রায়মূলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে বিবিধ (আদালত) মামলা সৃজন পূর্বক রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন প্রদানের নিমিত্ত প্রচুর বিবিধ মামলা আসছে, হেডম্যানের প্রতিবেদন ব্যতীত উক্ত বিবিধ মামলাগুলো পূর্বানুমোদন প্রদান করা হলে ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হতে পারে বিধায়, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের মতামত/নির্দেশনা প্রয়োজন।

উপযুক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে বর্ণিত বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামত/নির্দেশনার জন্য ০৩ (তিন) টি বিবিধ মামলার কাগজপত্রাদিসহ এতৎসঙ্গে প্রেরণ করা হলো।

স্বাক্ষর-
কৃষিবিদ কাজল তালুকদার
চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ
ফোনঃ ০২৩৩৩৩-৭১৬২৭।”

উক্ত চিঠির বিশ্লেষণ।

১. হেডম্যান প্রথার বৈষম্যমূলক চরিত্র:

পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনবিধি অনুযায়ী, হেডম্যান নিয়োগ করেন জেলা প্রশাসক, তবে তারা অবশ্যই উপজাতি সম্প্রদায় থেকে হতে হবে। অর্থাৎ, বাঙালিদের কখনো হেডম্যান হওয়ার সুযোগ নেই। এই হেডম্যানরা সমতলের তহশিলদারের মতো ভূমি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন—খাজনা উত্তোলন, জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সুপারিশ প্রত্যয়ন, বাসিন্দার স্থানীয়তা যাচাই ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক উপজাতি হেডম্যান বাঙালি আবেদনকারীর ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিবেদন দিতে গড়িমসি করেন বা অযৌক্তিকভাবে নেতিবাচক প্রতিবেদন দেন, যেখানে উপজাতিদের জন্য একই প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত ও অনুকূলভাবে সম্পন্ন হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে অভিযোগ আসছে, হেডম্যানরা বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে বাঙালি থেকে খাজনা গ্রহণ করছেন না, যার কারণে অনেক বাঙালি জমি-বেচাকেনা করতে পারছেন না।

২. আদালতের ভূমিকা ও আইনগত বাস্তবতা:

সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে (অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ৩১, ৪২)। ভূমি মালিকানা ও ক্রয়-বিক্রয় আদালতের স্বীকৃত রায়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার পর হেডম্যান প্রতিবেদনের মতো প্রথাগত ও বৈষম্যমূলক শর্ত সংযোজন করা আদালতের রায়কে অবমাননা করার শামিল। ইতিমধ্যেই উচ্চ আদালত বিভিন্ন সময়ে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির কিছু ধারা “মৃত আইন” বলে মন্তব্য করেছে, যা বর্তমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বাঙালি আইনজীবি ও বাসিন্দারা বলছেন, জেলা প্রশাসক আদালতের রায় বাস্তবায়নে বরাবরই অনিহা দেখাচ্ছে৷ সাংবিধানিক চেয়ারে বসে অসাংবিধানিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির অজুহাত দেখিয়ে আদালতের রায় বাস্তবায়ন করছেন না। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক অভিযোগ, একই জায়গা একাধিকবার বেচা-কেনা এবং অফিস থেকে বাঙালিদের জায়গার নথিপত্র গায়েব, ডিসির বাসিন্দা সনদ নিয়ে হয়রানিসহ এসব বিষয়ে বাঙালিদের মধ্যে দিনদিন ক্ষোভ বাড়ছে বলে জানা গেছে।

৩. অনির্বাচিত রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অবস্থান:

গত ২৯ জুলাই ২০২৫ তারিখের চিঠিতে কাজল তালুকদার মূলত বলছেন—হেডম্যান প্রতিবেদন ছাড়া আদালতের রায় অনুযায়ী জমি হস্তান্তরের অনুমোদন না দেওয়া হোক। এটি সুস্পষ্টভাবে অসাংবিধানিক, কারণ—

আদালতের রায়কে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে।
প্রচলিত ভূমি আইনকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। বৈষম্যমূলক উপজাতি-প্রধান প্রথাকে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

৪. সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব:

বাঙালিদের জন্য ভূমি ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়বে। আদালতের মাধ্যমে প্রাপ্ত ন্যায়বিচার অকার্যকর হয়ে যাবে। সংবিধান ও বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব খর্ব হবে। উপজাতি হেডম্যানদের হাতে একচেটিয়া ক্ষমতা থেকে যাবে, যা দুর্নীতি ও বৈষম্যকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

জমি ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে আদালত কি জেলা পরিষদ বা জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করে? আইনজ্ঞদের মতে, জমি লেনদেনের ক্ষেত্রে সাধারণত বাদি-বিবাদির মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। অনেক সময় এই চুক্তি কোর্ট এফিডেভিট বা হলফনামার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। যদি কোনো পক্ষ চুক্তি অমান্য করে, তবে বাদি-বিবাদি সিভিল স্যুট দায়ের করতে পারেন। আদালত এসব মামলায় ক্রেতা-বিক্রেতার চুক্তি বাস্তবায়ন এবং মালিকানা প্রদান সংক্রান্ত রায় দিয়ে থাকেন। এছাড়াও ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে কেউ কেউ আদালতের দারস্থ হন। কিন্তু জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে হেডম্যানের প্রত্যয়ন ব্যতীত জমি ক্রয়-বিক্রয়ের আদালতের রায় জটিলতা সৃষ্টি করছে —এমন বক্তব্য সম্পূর্ণ অসত্য, বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটির মাধ্যমে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি-বেচাকেনা বন্ধ করতে গভীর ষড়যন্ত্র করছেন বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।

স্থানীয় বাঙালিরা দাবি করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি-সংক্রান্ত সমতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে প্রথাগত হেডম্যান প্রতিবেদনের বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে আদালতের রায় ও প্রচলিত ভূমি আইনকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে হবে। রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ২৯ জুলাইয়ের চিঠি সংবিধান ও বিচার বিভাগের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এক প্রকার প্রশাসনিক বিদ্রোহের সমান, যা তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা প্রয়োজন।

রাষ্ট্রের জন্য জরুরি—পার্বত্য চট্টগ্রামে নাগরিক সমতার ভিত্তিতে ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা এবং বৈষম্যমূলক প্রথার অবসান ঘটানো। অন্যথায় এই অঞ্চলটি ন্যায়বিচারের চেয়ে প্রথাগত বৈষম্যের কারাগার হয়ে থাকবে।

আগের পোস্টদিঘীনালা বিপুল পরিমাণ ভারতীয় সিগারেট জব্দ করেছে সেনাবাহিনী।
পরের পোস্টবান্দরবানে অস্ত্রসহ কেএনএফের ঘোরাফেরার দৃশ্য দাবিতে ফিলিপাইনের ভিডিও প্রচার।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন