ভালবাসার জয়: পাহাড়ে উপজাতি তরুণী ও বাঙালি যুবকের অনন্য দাম্পত্য যাত্রা।

0

অনন্ত অসীম 

পাহাড়ি সমাজে প্রেম ও বিয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক সবসময় সহজ ছিল না। বিশেষ করে যখন উপজাতি তরুণী কোনো বাঙালি যুবকের প্রেমে পড়ে, তখন এই সম্পর্কের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর ভয়, সামাজিক চাপ, আর পুরনো বিভাজনমূলক প্রথার দেয়ালে। দীর্ঘদিন ধরে দেখা গেছে, এমন সম্পর্ককে পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো শুধু অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করেই ক্ষান্ত থাকে না, বরং মেয়ের পরিবারকে সামাজিকভাবে জরিমানা, বহিষ্কার এমনকি অপমানজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি করে। কখনো মেয়েকে অপহরণ করে ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে—গণধর্ষণ, নিলামে বিক্রি কিংবা হত্যা।

কিন্তু এই সব ভয়-ভীতি, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িক দেয়াল ভেদ করে এবার রচিত হলো এক অনন্য ইতিহাস। খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার এক উপজাতি তরুণী ইয়ানা আক্তার অঞ্জনা এবং এক বাঙালি যুবক মোঃ ইউনুস নিজেদের ভালবাসাকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এই সম্পর্ক কেবল দুজন মানুষের মিলন নয়, বরং পাহাড়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতির একটি সাহসী ঘোষণাও বটে।

কোর্ট ম্যারেজ

দীর্ঘদিনের পরিচয়, কথোপকথন ও মানসিক বন্ধনের মধ্য দিয়ে অঞ্জনা ও ইউনুস ধীরে ধীরে এগিয়েছেন একে অপরের দিকে। তাদের সম্পর্কের মূলভিত্তি ছিল আস্থা, বোঝাপড়া ও পারস্পরিক সম্মান। বয়সে, ধর্মে ও সংস্কৃতিতে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা কখনো নিজেদের বন্ধনকে ভেঙে ফেলেননি।

বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্কদের নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকার রয়েছে। এই অধিকার প্রয়োগ করেই তারা গভীর চিন্তাভাবনার পর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
এই বিয়ের ঘোষণাপত্রটি রেজি নং ৫৬১, তারিখ ১০/০৮/২০২৫ অনুযায়ী ফেনী জেলা জজ কোর্টের নোটারি পাবলিক অফিসে নিবন্ধিত হয়। ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক কাবিননামায় স্বাক্ষর করে তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন। দেনমোহর নির্ধারিত হয় ৩ লক্ষ টাকা, সঙ্গে অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা নগদ উসুল।

৩ লাখ টাকা দেনমোহর এবং ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ

এই সাহসী পদক্ষেপ শুধু প্রেমের পরিণতি নয়, বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পথে এক বাস্তবিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছে। অনেক সময় পাহাড়ি-বাঙালি সম্পর্ককে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু অঞ্জনা ও ইউনুস দেখিয়েছেন—মানুষের মধ্যে বন্ধনের আসল শক্তি জাতি, ধর্ম বা ভাষার সীমানায় বাঁধা পড়ে না।

সচেতন নাগরিকরা তাদের এই বিয়ে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলেছেন, এমন সাহসী দৃষ্টান্ত পাহাড়ে বিভাজন কমাবে, পারস্পরিক আস্থা বাড়াবে এবং তরুণ প্রজন্মকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেবে। তবে কিছু উগ্রবাদী হুমকি প্রদর্শন এবং নেতিবাচক মন্তব্য করেছে৷ এটির জন্য এই জুটিকে আপাতত নিরাপত্তা বজায় রাখা উচিত বলে মনে করেন সচেতন নাগরিকরা।

পাহাড়ে এমন ঘটনা বিরল নয় যে প্রেম বা বিয়ে ‘অগ্রহণযোগ্য’ ঘোষণার পর দুঃখজনক পরিণতি ঘটে। এই বাস্তবতায় অঞ্জনা ও ইউনুসের সিদ্ধান্ত কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি সামাজিক সাহসিকতার প্রতীক। তারা প্রমাণ করেছেন—ভালবাসা যদি হয় সত্যিকারের, তবে সেটি সব বাধা অতিক্রম করতে পারে।

এমন সম্পর্ক যদি বাড়তে থাকে, তবে পাহাড়ে দীর্ঘদিনের জাতিগত বিভাজন ও ভুল বোঝাবুঝি কমে আসতে পারে। পারস্পরিক বিবাহ একে অপরের সংস্কৃতিকে জানার সুযোগ তৈরি করবে, যা সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাবও কমিয়ে দেবে। এতে শুধু মানবিক সম্পর্ক নয়, বরং জাতীয় ঐক্যও সুদৃঢ় হবে।

অঞ্জনা ও ইউনুসের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রেম কোনো প্রাচীর মানে না। পাহাড়ের বাতাসে এবার বইছে সম্প্রীতির হাওয়া। এই বিয়ে হোক নতুন এক সহাবস্থানের সূচনা, যেখানে মানুষ মানুষকে চিনবে তার হৃদয়ের রঙে, জন্মসূত্রের পরিচয়ে নয়।

আলোচিত এই জুটির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অঞ্জনা ত্রিপুরা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করে নিজেদের জন্য আশীর্বাদ কামনা করেছেন।

অঞ্জনা ত্রিপুরা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট
আগের পোস্টলংগদুতে বন্যার্ত পাঁশ শতাধিক মানুষকে সেনাবাহিনীর রান্না করা খাবার ও ত্রাণ সহায়তা প্রদান।
পরের পোস্টরামগড়ে নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ, ভোগান্তি চরমে!

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন