হান্নান সরকার | পার্বত্য চট্টগ্রাম
পার্বত্য চট্টগ্রাম বরাবরই এক রহস্যময় ভূখণ্ড, যেখানে পাহাড়-অরণ্যের আবরণে লুকিয়ে আছে বহু ষড়যন্ত্রের জটিল নকশা। এই নকশার নব্য নির্মাতা সুহাস চাকমা, যিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশী হলেও আজ ভারতের নাগরিক পরিচয় ধারণ করে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। তার জীবনকাহিনি একদিকে যেমন প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং দ্বিচারিতার প্রতীক, অন্যদিকে তা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য এক ভয়ংকর হুমকি।
সুহাস চাকমার জন্ম রাঙামাটি জেলার হারুবিল এলাকায়। তার পিতা রঞ্জন বিকাশ চাকমা খাগড়াছড়ির পানছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কর্মসূত্রে পরিবারটি পানছড়িতে বসবাস শুরু করে। তবে শিক্ষকের চাকরি ছাড়াও রঞ্জন বিকাশ চাকমার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা তাকে ভিন্ন ধারার পথে নিয়ে যায়। ১৯৮২ সালে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এ যোগ দেন। এই সূত্রে সুহাস চাকমা জেএসএস-এর অর্থায়নে শিক্ষালাভ করে। কিন্তু পরবর্তীতে তার পিতা সংগঠন থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
এখানেই শেষ নয়। সুহাস চাকমার শ্বশুর উপেন্দ্র লাল ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের একজন নির্বাচিত সদস্য। ফলে সুহাসের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক যোগাযোগও অস্বাভাবিকভাবে বিস্তৃত হয়। কিন্তু এসব সুযোগকে রাষ্ট্রীয় কল্যাণে না লাগিয়ে তিনি বিপথগামী হন।

পরিচয় পরিবর্তনের কৌশল:
সুহাস চাকমার জীবনে সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য হলো তার নাম-পরিচয়ের খেলাঘর। বাংলাদেশে তার নাম ছিল বোধিমিত্র চাকমা। ভারতে প্রবেশের পর তিনি হয়ে যান সুহাস চাকমা। তার স্ত্রী গ্লোরি চাকমাও নাম পরিবর্তন করে হন নিতালি দেওয়ান। এমনকি শ্বশুরের নামও রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ায় কনক বরণ দেওয়ান। এই নামপরিবর্তনের কৌশল নিছক পরিচয়ের ভিন্নতা নয়, বরং আইন ও রাষ্ট্রের প্রতি স্পষ্ট বিদ্রোহ। এটি প্রমাণ করে যে তারা পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশি পরিচয় মুছে ফেলে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে নিজেদের পুনর্গঠন করেছে।
অবৈধ সম্পদ ও এনজিওর ছদ্মবেশ:
সুহাস চাকমার এক বড় পরিচয় হলো তথাকথিত মানবাধিকার কর্মী। কিন্তু তার প্রকৃত রূপ এক ভয়ঙ্কর প্রতারক। এনজিওর নামে তিনি আন্তর্জাতিক দাতাদের সহানুভূতি আদায় করেন, কিন্তু এর অর্থ ব্যয় হয় ব্যক্তিগত বিলাসিতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে। তার মালিকানায় দিল্লিতে ছয়টি ফ্ল্যাট এবং তিন একরেরও বেশি জমি রয়েছে। প্রশ্ন হলো—একজন এনজিও কর্মী কীভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন? এর উত্তর স্পষ্ট—দাতাদের প্রতারণা ও সাধারণ মানুষকে ব্রেইনওয়াশ করে অর্থ লুট।

ইউপিডিএফ সংযোগ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড:
বর্তমানে সুহাস চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিবিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফ-এর অন্যতম মুখপাত্র। অস্ত্র ও গোলাবারুদের ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা—সবকিছুতেই তার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো তার নিত্যদিনের কাজ। এই প্রচারণা শুধু বিভ্রান্তিই তৈরি করছে না, বরং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করছে।
আন্তর্জাতিক প্রচারণা ও প্রতারণা:
সুহাস চাকমা নিয়মিত বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চিঠি প্রেরণ করে। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গালগল্প তৈরি করে উপস্থাপন করেন। অথচ বাস্তবতা হলো, সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলে উন্নয়ন, শিক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরামহীন কাজ করছে। তথাকথিত মানবাধিকারের আড়ালে সুহাস চাকমা মূলত অন্য কারো স্বার্থ রক্ষা করছে।
বিভাজন সৃষ্টির অপকৌশল:
জেএসএস নেতা সন্তু মারমার সঙ্গেও তার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। সন্তু মারমার সমর্থকরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে দুজনের স্বার্থ এক জায়গায় এসে মিলে যায়। সুহাস চাকমা প্রমাণ করেছেন, ভেতরে ভেতরে ভিন্নমত থাকলেও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে তারা একাট্টা। এটি কেবল বিশ্বাসঘাতকতার নয়, বরং রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
নাগরিকত্ব প্রশ্নে দ্বিচারিতা:
ভারতে চাকমা ও হাজংদের নাগরিকত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে টানাপোড়েন চলছে। সুহাস চাকমা এই ইস্যুকে কৌশলে ব্যবহার করে। তিনি নিজে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েও অন্যদের বিরুদ্ধে নাগরিকত্ব প্রশ্নে অভিযোগ তোলেন। যেমন তিনি অভিযোগ করেছেন, সন্তু মারমার দুই মেয়ে—জুলিয়ানা লারমা ও উজানা লারমা ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। প্রশ্ন হলো, যদি তার অভিযোগ সত্য হয় তবে এটি রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতা। সন্তু লারমা বাংলাদেশের উপমন্ত্রী পদমর্যাদা সুবিধা ভোগ করেও ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা দেশদ্রোহিতা ছাড়া আর কিছু নয়।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি:
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অভিজ্ঞতা রাখেন বিশ্লেষকরা মনে করেন, সুহাস চাকমা রাষ্ট্রের প্রতি চরম অবিশ্বস্ত। তিনি ‘মানবাধিকার’ শব্দকে ছদ্মবেশ হিসেবে ব্যবহার করে প্রকৃতপক্ষে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে লালন করছেন। তার কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয় যে তিনি কেবল ব্যক্তিস্বার্থে নয়, বরং বৃহৎ ভারতীয় ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ করছেন।

রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর বার্তা:
সুহাস চাকমার কর্মকাণ্ড নিছক কোনো ব্যক্তিগত প্রতারণা নয়। এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য ভয়াবহ হুমকি। তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন, সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন এবং তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছেন।
সুহাস চাকমা এক দ্বিচারী চরিত্র। জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হলেও আজ তিনি বিদেশি শক্তির দালাল। তার নামপরিবর্তন, অবৈধ নাগরিকত্ব, এনজিওর ছদ্মবেশ, বিপুল সম্পদ, পার্বত্য বিচ্ছিন্নতাবাদী ইউপিডিএফ-সংযোগ—সবই রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রকট উদাহরণ। তিনি শুধু ব্যক্তি নন, বরং এক ভয়ংকর প্রতীক, যার মাধ্যমে প্রমাণ হয়—যদি রাষ্ট্র সতর্ক না হয় তবে বিশ্বাসঘাতকেরা ভেতর থেকেই দেশকে ক্ষয় করে দেবে।
রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো এমন প্রতারকদের মুখোশ উন্মোচন করা। কারণ রাষ্ট্রদ্রোহিতা কোনো ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, এটি জাতির অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ অপরাধ।