উপজাতি সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা প্রায়শই রোমান্টিকভাবে চিত্রিত হয়। তাদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং সমাজব্যবস্থাকে সাদাসিধে, অপরাধমুক্ত এবং প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই চিত্রের পিছনে লুকিয়ে আছে কিছু কঠোর বাস্তবতা, যা আমাদের সমাজের দ্বিমুখীতা এবং মিডিয়ার পক্ষপাতিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিশেষ করে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের ক্ষেত্রে, যখন অভিযুক্তরা স্বজাতি হয়, তখন নীরবতা এবং অস্বীকারের একটি দেওয়াল তৈরি হয়। এই ব্লগে আমি একটি সাম্প্রতিক ঘটনা এবং একটি পুরনো মিথ্যা ধারণাকে বিশ্লেষণ করব, যা দেখিয়ে দেয় যে উপজাতি সমাজও অপরাধ থেকে মুক্ত নয়, এবং আমাদের সমাজের কিছু অংশ এই সত্যকে স্বীকার করতে অনিচ্ছুক। এই আলোচনা আমাদেরকে আরও সচেতন এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সাহায্য করবে।
বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায়, পাইন্দু ইউনিয়নের পাইন্দু হেডম্যান পাড়ায়, একটি পঞ্চম শ্রেণির উপজাতি শিশু ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা সম্প্রতি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনায় অভিযুক্ত পাঁচজন ধর্ষণকারী সবাই স্বজাতি, অর্থাৎ একই মারমা সম্প্রদায়ের সদস্য। কিন্তু যা আরও চিন্তাজনক, তা হলো স্থানীয় সামাজিক নেতাদের ভূমিকা। তারা একটি সামাজিক সালিশি বিচারের মাধ্যমে অভিযুক্তদের মাত্র ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দিয়েছে, যা বাকিতে পরিশোধের অজুহাতে করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায় যে, মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) বেলা ১১টার দিকে এই সালিশি বিচার বসানো হয়। বিচারে নেতৃত্ব দেন পাইন্দু ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার গংবাসে মার্মা এবং পাইন্দু মৌজার হেডম্যান মংচউ মার্মা। সভাপতিত্ব করেন পাইন্দু পাড়া প্রধান কারবারী থোয়াইসা মার্মা। এই ঘটনা এলাকায় চরম ক্ষোভ এবং অসন্তোষের ঝড় তুলেছে। অভিযোগ আছে যে, ভিকটিমের পরিবারকে পাড়ায় আটকিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে তারা আইনি পদক্ষেপ নিতে না পারে।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর বক্তব্য অনুসারে, চলতি মাসের প্রথমে পাইন্দু হেডম্যান পাড়ার বাসিন্দা রাংমেশে মার্মার ছেলে শৈহাইনু মার্মা তাকে ধর্ষণ করে। এই ঘটনা তার বন্ধু ক্যাহ্লা ওয়াইং, ক্য ওয়ং সাই, চহাই, উহাই সিং এবং ক্য সাই ওয়ং জানতে পারে। তারা সুযোগ বুঝে ভয় দেখিয়ে পর্যায়ক্রমে তাকে ধর্ষণ করে। পরে শিশুটি তার পরিবারকে জানায়, এবং বিষয়টি জানাজানি হয়। তখন কারবারী থোয়াইসা মার্মার বাসভবনে সালিশি বিচার করা হয়।
মেম্বার গংবাসে মার্মা জানিয়েছেন যে, অভিযুক্তদের মোট ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে, যা কয়েকদিনের মধ্যে জমা দেওয়া হবে এবং ভুক্তভোগীকে দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন যে, ভুক্তভোগীর অভিভাবক এবং পাড়াবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে এই সালিশি করা হয়েছে। কিন্তু এই ধরনের সালিশি কি সত্যিই ন্যায়বিচার? একটি শিশুকে গণধর্ষণের মতো অপরাধের জন্য মাত্র অর্থদণ্ড এবং তাও বাকিতে – এটি তো অপরাধীদের উৎসাহিত করার মতো।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার জানিয়েছেন যে, ঘটনাটি জানার পর তিনি রুমা থানার ওসিকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই তদন্ত কতদূর যাবে? পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক সালিশির প্রভাব প্রায়শই আইনি প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়।
এই ঘটনা আরও চিন্তাজনক কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম এবং সমতলের কিছু বাম সংগঠন তাৎক্ষণিকভাবে বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ করে এবং বাঙালিদের অভিযুক্ত করে। কিন্তু যখন অভিযুক্ত স্বজাতি, তখন তাদের নীরবতা অস্বস্তিকর। এই দ্বিমুখীতা কি রাজনৈতিক স্বার্থের ফল? নাকি উপজাতি সমাজের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা?
এই ঘটনা আমাদেরকে একটি পুরনো মিথ্যা ধারণার সামনে দাঁড় করায়, যা আমাদের দেশের তথাকথিত গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজ প্রচার করে। উদাহরণস্বরূপ, ০১ নভেম্বর ২০২০ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় রাজশাহী প্রতিনিধি আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদের একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি বখতিয়ার আহমেদের গবেষণা উদ্ধৃত করে বলা হয় যে, ৩৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষায় ‘ধর্ষণ’ শব্দের প্রতিশব্দ নেই। চাকমা, মার্মা, খুমি, মাহ্লেসহ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনে ধর্ষণের মতো ঘটনা ছিল না বলেই এর প্রতিশব্দ তৈরি হয়নি।
প্রথম আলোর কলামে আরও বলা হয় যে, বাংলাদেশের ৩৩ টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় ধর্ষণ শব্দের প্রতিশব্দ নেই। তাদের সমাজ সাদাসিধে, অপরাধপ্রবণতা কম, এবং এর প্রভাব পড়েছে সংস্কৃতি ও ভাষায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক মো. ইলতেমাসও প্রথম আলোকে বলেন যে, দেশে বাংলাসহ ৪১টি ভাষা রয়েছে, এবং যেসব জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় ধর্ষণ শব্দটি নেই, তাদের সমাজে এই অপরাধ নেই। বখতিয়ার আহমেদ আরও যোগ করেন যে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রথাগত সমাজে ত্রাসনির্ভর রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুপস্থিত, তাই ধর্ষণের মতো বলপ্রয়োগ ঘটে না।
কিন্তু এই দাবি কতটা সত্য? বান্দরবানের রুমার ঘটনা তো স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে, উপজাতি সমাজেও ধর্ষণ হয়, এবং তা স্বজাতি দ্বারা। এই মিথ্যা ধারণা প্রচার করে মিডিয়া এবং সুশীল সমাজ উপজাতি পুরুষদের ধর্ষণের সত্যতা অস্বীকার করে। এটি একটি রোমান্টিকাইজড চিত্র তৈরি করে, যা বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। যদি ভাষায় শব্দ না থাকে, তাহলে কি অপরাধ হয় না? নাকি অপরাধ লুকিয়ে রাখা হয় প্রথাগত সালিশির মাধ্যমে? এই ধারণা উপজাতি নারীদের অধিকারকে আরও দুর্বল করে তোলে, কারণ এটি সমস্যাকে অস্বীকার করে।
এই দুটি তথ্য – রুমার ঘটনা এবং প্রথম আলোর প্রতিবেদন – একসাথে দেখলে বোঝা যায় যে, আমাদের সমাজে উপজাতি সম্প্রদায়কে আদর্শায়িত করার একটি প্রবণতা আছে, যা বাস্তবতাকে ঢেকে দেয়। যখন ধর্ষণের অভিযোগ বাঙালিদের বিরুদ্ধে, তখন প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কিন্তু স্বজাতি দ্বারা হলে নীরবতা। এটি রাজনৈতিক, যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সংঘাতকে কেন্দ্র করে। মিডিয়া এবং সংগঠনগুলোর এই পক্ষপাতিত্ব শিশু এবং নারীদের সুরক্ষাকে বিপন্ন করে।
আরেকটি উদাহরণ হলো: এর আগে চলতি বছরের ১১ মার্চে প্রথাগত সামাজিক বিচারে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণ চেষ্টার অপরাধে অভিযুক্তকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনায় ৪০ হাজার টাকা জরিমানা শিরোনাম হয়েছিল সারা দেশ। সেখানে পাহাড়ি সংগঠনগুলো অভিযোগ তুলেছিল, এই বিচারে বাধ্য করেছে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পের মেজর৷ পরবর্তী এই খবর জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে নালিশ করে জেএসএস সন্তু গ্রুপের প্রতিনিধি অগাস্টিনা চাকমা। রুমার শিশু গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে জেএসএস বা ইউপিডিএফ জাতিসংঘে নালিশ করবে কিনা আমার বোধগম্য নয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, তারা বাছাইকৃত ও ইস্যু ভিত্তিক বিষয়গুলো জাতিসংঘে তুলে ধরে।
পাহাড়ে সবধরনের ধর্ষণ বন্ধে প্রয়োজন আইনি হস্তক্ষেপের। সামাজিক সালিশি অপরাধকে ছোট করে দেখতে পারে না। পুলিশ এবং আদালতকে সক্রিয় করতে হবে। উপজাতি সমাজের নারী সংগঠনগুলোকে এই ঘটনায় কথা বলতে হবে। শিক্ষা এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে ভাষায় শব্দ না থাকলেও অপরাধকে চিহ্নিত করা যায়।
উপজাতি সমাজের অন্ধকার দিকগুলোকে অস্বীকার করে আমরা কাউকে সাহায্য করছি না। রুমার ঘটনা এবং মিথ্যা ধারণাগুলো দেখিয়ে দেয় যে, ধর্ষণ সর্বত্র হয়, এবং তা মোকাবিলা করতে হলে নিরপেক্ষতা দরকার। আমাদের সমাজকে আরও সমতুল্য করতে এই আলোচনা জরুরি। শেষ কথা: ন্যায়ের জন্য সকলের কণ্ঠস্বর উঠুক, জাতি বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে।