পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যাক্রমে নেটওয়ার্ক বিপর্যয় ঘটতে পারে।

0

হান্নান সরকার 

নয়নাভিরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম সাম্প্রতিক সময়ে এ অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। টেলিযোগাযোগ খাত দেশের প্রতিটি নাগরিককে সংযুক্ত রাখার অন্যতম অবলম্বন হলেও, পাহাড়ি অঞ্চলে তা আজ কার্যত ভেঙে পড়েছে। মূলত বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-প্রসীত গ্রুপ) এর চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হামলার কারণে এ বিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়েছে।

সূত্র মতে, দীর্ঘদিন ধরেই রবি আজিয়াটা পিএলসি কোম্পানি ইউপিডিএফকে চাঁদা দিয়ে আসছিল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে বাৎসরিকভাবে তাদের প্রায় ৭০ লাখ টাকা প্রদান করা হতো। কিন্তু ২০২৫ সালের শুরুতে ইউপিডিএফ এ অঙ্ক কয়েকগুণ বাড়িয়ে ৫ কোটি টাকা দাবি করে। কোম্পানি তা পরিশোধে অস্বীকৃতি জানালে ইউপিডিএফ রবি ও এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক টাওয়ারে হামলা, টেকনিশিয়ান অপহরণ এবং হত্যার হুমকি প্রদান শুরু করে। এর ফলে পার্বত্য অঞ্চলের নানা এলাকায় ধাপে ধাপে নেটওয়ার্ক বিপর্যয় দেখা দেয়। এই নিয়ে স্থানীয় নিউজপোর্টালে উপজেলাগুলোর নেটওয়ার্ক বিপর্যয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় নেটওয়ার্ক সংকট চরম আকার ধারণ করে। কল ড্রপ, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্নতার কারণে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছেন।

প্রেসক্লাব সভাপতি আব্দুল মাবুদ জানান, “নেটওয়ার্ক এখন কোনো বিলাসিতা নয়, বরং মৌলিক চাহিদা। বিদ্যুৎ না থাকলেই নেটওয়ার্ক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে জরুরি সময়ে রোগী পরিবহন বা চিকিৎসককে খবর দেওয়াও সম্ভব হয় না।”

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এ উপজেলায় একাধিকবার টাওয়ার লাইন কেটে দেওয়া ও টেকনিশিয়ানকে হুমকির ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, সমস্যা দ্রুত সমাধান না হলে বাঘাইছড়িও বরকলের মতো নেটওয়ার্ক অচল অবস্থায় চলে যাবে।

রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা। কয়েকদিন ধরে পুরো উপজেলা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

শিক্ষার্থী সুমি চাকমা বলেন, “আমাদের অনলাইন ক্লাস ও অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। নেটওয়ার্ক না থাকায় ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।”

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বন্ধ থাকায় তাদের লেনদেন সম্পূর্ণ অচল হয়ে গেছে। স্থানীয়রা কোম্পানির দায়িত্বহীনতা ও প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছেন।

গত ১২ আগস্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায় গত দুই মাস ধরে নেটওয়ার্ক বিপর্যয় চলছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রবি, গ্রামীণফোন ও টেলিটকের ৯টি টাওয়ার থাকলেও অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টাওয়ারের এক কেয়ারটেকার জানান, “ইউপিডিএফ সদস্যরা এসে হুমকি দিয়েছে—তাদের অনুমতি ছাড়া টাওয়ারে কোনো কাজ করা যাবে না।”

এর ফলে হাজার হাজার মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। জরুরি চিকিৎসা, প্রবাসী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সরকারি কাজকর্ম সম্পূর্ণ ব্যাহত হচ্ছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রাঙামাটির বরকল উপজেলায়। ১৫ জুলাই ২০২৫ থেকে ইউপিডিএফের চাঁদার দাবিতে এখানে রবি ও এয়ারটেলের ৮টি টাওয়ার একে একে বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সমগ্র পার্বত্য থেকে ৫ কোটি টাকা চাঁদা চাইলেও বিস্ময়করভাবে ইউপিডিএফ শুধু বরকল উপজেলাতেই ৬ কোটি টাকা দাবি করেছে। ফলে পুরো উপজেলাই কার্যত নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

জানা গেছে, খাগড়াছড়ির পানছড়ি, দিঘিনালা ও লক্ষ্মীছড়ির অর্ধেকের বেশি এলাকায় নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন। তবে রাঙামাটির নানিয়ারচর, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও রাজস্থলীর দুর্গম এলাকায় নেট স্পীড কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বান্দরবানের নেটওয়ার্ক টাওয়ারগুলোর সংযোগ বন্ধ করে দিতে রবি কোম্পানির উপর চাপ অব্যাহত রেখেছে ইউপিডিএফ। নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে এই চাপ প্রয়োগ করছে।

সূত্র বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব এলাকায় ইউপিডিএফ এর কার্যক্রম রয়েছে সেখানে নেটওয়ার্ক সংযোগ একদম বন্ধ রয়েছে, অন্যান্য জায়গা যেখানে ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রণ নেই সেখানে রবি কোম্পানিকে চাপ প্রয়োগ করে নেটওয়ার্ক সেবা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে৷

এ অবস্থায় প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের অনলাইন পড়াশোনা, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের যোগাযোগ, এমনকি জরুরি চিকিৎসা সেবাও ভেঙে পড়ে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, “মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বন্ধ থাকায় প্রতিদিনই লেনদেনে ক্ষতির মুখে পড়ছি। বিকাশ বা নগদ ছাড়াই ব্যবসা করা এখন প্রায় অসম্ভব।”

নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের অন্যতম বড় কারণ হলো চাঁদা দাবির পাশাপাশি টাওয়ার টেকনিশিয়ানদের ওপর হামলা ও অপহরণ।

গত ১৯ এপ্রিল ২০২৫, খাগড়াছড়ির মানিকছড়ির ময়ূরখীল এলাকায় রবি কোম্পানির দুই টেকনিশিয়ান অপহৃত হন। গত ৫ জুন ২০২৫, ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নে আরও দুই টেকনিশিয়ান অপহৃত হন।

মোট চারজন কর্মী এখনো নিখোঁজ। এর আগে জানুয়ারি মাসে ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ির দিঘিনালা, গুইমারা মাটিরাঙ্গা এবং রাঙামাটির নানিয়ারচর এলাকায় প্রায় ৫০টির বেশি টাওয়ারে হামলা চালিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ও সরঞ্জাম লুট করে।

বাংলাদেশ প্রাইভেট টেলিকমিউনিকেশন কর্মচারী ইউনিয়ন একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে তাদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে।

পর্যাক্রমে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা:

সূত্রে তথ্য মোতাবেক এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ইউপিডিএফের চাঁদা না মেটালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যাক্রমে পুরো নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। ইতোমধ্যেই দিঘিনালা, নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি, লংগদু, জুরাছড়ি, রামগড় ও বরকল উপজেলায় ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে লক্ষ্মীছড়ি, পানছড়ি, জুরাছড়ি, রাজস্থলী ও বিলাইছড়ির মতো দুর্গম এলাকাগুলোতেও ধীরগতিতে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান অবস্থায় রবি কোম্পানি ধীরে ধীরে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হতে পারে। এটি দেশের সংহতি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য গুরুতর হুমকি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের নেটওয়ার্ক বিপর্যয় শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত সংকট নয়, বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। ইউপিডিএফের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে রাষ্ট্র যদি বারবার পরাজিত হয়, তবে এর প্রভাব পড়বে গোটা দেশের ওপর।

স্থানীয় অধিবাসীরা দাবি করছেন,
সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশলগত তৎপরতা বৃদ্ধি, টাওয়ার রক্ষণাবেক্ষণে নিরাপত্তা জোরদার, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, টেলিকম কোম্পানিগুলোকে নিরাপত্তা সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন। না হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আধুনিক প্রযুক্তির যুগে থেকেও “অন্ধকারে” নিমজ্জিত হবে, যা শুধু এ অঞ্চলের নয় বরং গোটা বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়াবে অভিমত প্রকাশ করেন।

আগের পোস্টবান্দরবানে শিশু গণধর্ষনের প্রতিবাদে পিসিসিপির মানববন্ধন ও বিক্ষোভ।
পরের পোস্টরাঙামাটি পর্যটন শহরে চাঁদাবাজি, জনমতে আতঙ্ক।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন