পার্বত্য চট্টগ্রাম এক অদৃশ্য আতঙ্কের দখলে। পাহাড়ের বুকে লালচে ক্ষত তৈরি করেছে আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি। গ্রাম থেকে শহর, ব্যবসা থেকে উন্নয়ন প্রকল্প, এমনকি সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিটি কোণায় আজ নেমে এসেছে এক ভয়ংকর শ্বাসরোধী অন্ধকার। পাহাড়ের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবন এক নির্মম রক্তচোষা চক্রের হাতে জিম্মি।
চাঁদাবাজির ধরন এত বহুমুখী যে তালিকা করলেও শেষ হয় না, গণচাঁদা, মাসিক চাঁদা, বাৎসরিক চাঁদা, ব্যবসায়িক চাঁদা, অবৈধ কাঠ চাঁদা, বাঁশ চাঁদা, যানবাহন চলাচল চাঁদা, পণ্য ক্রয়-বিক্রয় চাঁদা, উন্নয়ন প্রকল্পের চাঁদা। এমন কোনো খাত নেই যেখানে প্রসীত গ্রুপের ইউপিডিএফ, সন্তু গ্রুপের জেএসএস, সংস্কারবাদী জেএসএস, কিংবা তথাকথিত গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ নিজেদের লম্বা হাত প্রসারিত করেনি।
সম্প্রতি রাঙামাটি শহরে মাথা তুলেছে এক নতুন চাঁদাবাজ চক্র। ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নেমে এসেছে কোটি টাকার চাঁদার খড়্গ। কখনো জেএসএস, কখনো ইউপিডিএফ, আবার কখনো সংস্কার কিংবা গণতান্ত্রিক পরিচয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অর্থ। মোবাইল ফোনে হুমকি, দূত পাঠিয়ে দাবি, কিংবা সশস্ত্র প্রভাব, সবকিছুই চলছে একসাথে।
শহরের দোয়েল চত্বরেই সম্প্রতি বিদেশি অর্থায়নে নির্মাণাধীন একটি প্রকল্পে এসে মাইক্রোযোগে সন্ত্রাসীরা দাবি করেছে ২০ লাখ টাকা। প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে যদি টাকা না দেওয়া হয়। এই ঘটনার সাক্ষী অনেকেই, কিন্তু মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা নিরুপায় হয়ে পড়েছেন “টাকা না দিলে ব্যবসা চালানো যাবে না”, এটাই এখন তাদের রোজনামচা।
অভিযোগ করলেই প্রতিশোধের শিকার হতে হবে এ ভয় ব্যবসায়ীদের কণ্ঠরোধ করেছে। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, তাদের কাছে লিখিত বা মৌখিক কোনো অভিযোগ নেই। কোতয়ালী থানার ওসি বলছেন, “অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন আতঙ্কই ব্যবসায়ীর শিরায় শিরায় ঢুকে গেছে, তখন কে আর এগোবে প্রশাসনের দ্বারে?
অভিযোগ যখন তীব্র, তখনই ইউপিডিএফ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দায় এড়াতে চেয়েছে। তারা বলছে, কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা ও ‘অর্কিড’ নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করছে। ০১৮৬৩৯১০২১, ০১৮৪৬৮৯৪৫০৮, ০১৫৭৫৬৪৬১৩৩, ০১৮৫৮০৩৯৬১৩, ০১৮৮৮২৩২৫৯১ ও ০১৮৬৭৫৭০৩২৩ এই মোবাইল নম্বরও প্রকাশ করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ জানে নাম পাল্টানো, অস্বীকার করা, বিভ্রান্তি ছড়ানোই এই সন্ত্রাসী দলগুলোর পুরোনো কৌশল। নিজেরা চাঁদাবাজি করেও দায় চাপিয়ে দেয় “অসাধু ব্যক্তি” বা “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চক্র”-এর ঘাড়ে। এভাবেই পাহাড়ের রক্তচোষা গোষ্ঠীগুলো বারবার বেঁচে যায়।
অর্থনীতির গলা চেপে ধরা: চাঁদাবাজির ভয়ংকর প্রভাব পড়ছে সরাসরি পাহাড়ের অর্থনীতিতে। বিনিয়োগকারীরা পিছু হটছে। ব্যবসা-বাণিজ্য অচল হয়ে যাচ্ছে।
নির্মাণ কাজ থমকে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ প্রতিদিন দিশেহারা আতঙ্কে বেঁচে আছে।
যদি দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে পাহাড়ে অর্থনৈতিক মৃত্যু নিশ্চিত।
ইউপিডিএফ প্রসীত, জেএসএস সন্তু, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, জেএসএস সংস্কার, সবাই একই সন্ত্রাসী মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অধিকারের আড়ালে, জাতিগত পরিচয়ের ঢাল ব্যবহার করে, চুক্তির আলোচনার আড়াল নিয়ে তারা পাহাড়ের বুক রক্তাক্ত করছে। একদিকে অস্ত্র, অন্যদিকে চাঁদাবাজি এমন দ্বিমুখী খেলা পাহাড়ের মানুষকে পরিণত করেছে জিম্মিতে।
রাঙামাটির মানুষ আজ এক সুরে বলছে “আর নয়”। সচেতন সমাজ মনে করে, এখনই যদি এই চাঁদাবাজ চক্র দমন না করা হয়, তাহলে স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। পর্যটন শহর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। সবচেয়ে বড় বিপদ, পাহাড়ে আবারও অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে।
পাহাড়ের আঞ্চলিক সন্ত্রাসীরা আজ “রাজনীতি” নয়, “মাফিয়া সিন্ডিকেটে” পরিণত হয়েছে। এরা মুক্তির আন্দোলন নয়, মুক্তিপণের আন্দোলন চালাচ্ছে। এরা জনগণের রক্ষক নয়, জনগণের রক্তচোষা। প্রশাসন যদি এখনই কঠোর না হয়, তবে পাহাড়ের প্রতিটি বাজার, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প হয়ে উঠবে চাঁদাবাজির জিম্মিখানা।
আজ সময় এসেছে ভয় ভেঙে দাঁড়াবার। পাহাড়ের মানুষকে মুক্ত করতে হলে এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে নামতে হবে সর্বশক্তি নিয়ে। অন্যথায় আগামী প্রজন্ম শুধু পাহাড় নয়, পুরো দেশকেই হারাবে চাঁদাবাজি নামক কালো অন্ধকারে।