পার্বত্য রাঙামাটি জেলা পরিষদের বৈষম্যমূলক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি।

0

পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি বৈচিত্র্যময় অঞ্চল, যা দেশের আয়তনের এক-দশমাংশ। এখানে বাঙালি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, খুমি, চাক, লুসাই, পাংখোয়া, তংচঙ্গ্যা, মুরংসহ ১৩টি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। বহুকাল ধরেই এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, নিয়োগে প্রভাব বিস্তার ও প্রাতিষ্ঠানিক অসঙ্গতি নিয়ে নানা অভিযোগ উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি (স্মারক নং: ৩৮.০১.০০০০.০০৩.১১.০০২.২৫-২৬৩, তারিখ: ২৭ আগস্ট ২০২৫) নতুন করে ক্ষোভ ও বিতর্ক উসকে দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তির ১৬ নম্বরে বলা হয়েছে, কোটা সম্পর্কিত সরকারের সর্বশেষ জারিকৃত বিধিবিধান যা, পার্বত্য অঞ্চলের প্রযোজ্য নীতিমালা অনুসরণ করা হবে, এটি স্থানীয়ভাবে “মনগড়া, বৈষম্যমূলক ও আইনসম্মত নয়” বলে সমালোচিত হয়েছে।

নিয়োগে বৈষম্যের চিত্র নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে যে জেলা পরিষদের অধিকাংশ নিয়োগে চাকমা সম্প্রদায়ের প্রার্থীরাই প্রাধান্য পান। এরপর থাকে মারমা ও ত্রিপুরা। অথচ বাঙালি মুসলিম, হিন্দু ও বড়ুয়া মিলিয়ে নিয়োগের হার ১০ শতাংশেরও কম। স্থানীয়দের মতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বৈষম্য, ঘুষ লেনদেন, প্রশ্নফাঁস এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো নিয়মিত ঘটনা। এর ফলে বাঙালি ও অন্যান্য ছোট জাতিগোষ্ঠীর প্রার্থীরা বারবার বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা স্পষ্টভাবে বলছে, প্রত্যেক নাগরিক সমান সুযোগের অধিকারী। প্রশ্ন জাগে, তখন কেন পার্বত্য জেলা পরিষদ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতে আলাদা নিয়ম চাপিয়ে দিয়ে বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখছে?

বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক। সারা দেশে কোটার বৈষম্যের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে এবং ২০২৪ সালের সংঘটিত জুলাই বিপ্লবের পর সরকার উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ৫ শতাংশ কোটা কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনে। এর অর্থ হলো, জাতীয়ভাবে এখন আর উপজাতিদের জন্য অতিরিক্ত সুবিধা বহাল নেই। কিন্তু রাঙামাটি জেলা পরিষদ এখনও সেই পুরনো অজুহাত টেনে এনে নিয়োগে কোটার অপব্যবহার করছে। বাংলাদেশে উপজাতির সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম, অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এই কোটার সুযোগ দেখিয়ে মূলত চাকমা সম্প্রদায়কে একচেটিয়া নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে অন্য উপজাতি এবং বাঙালিরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

এখানে আরেকটি বৈপরীত্যও স্পষ্ট। যে জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনের ফলে বৈষম্যমূলক কোটার সংস্কার হয়েছিল, সেই আন্দোলনের ফসল হিসেবে কাজল তালুকদার রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ পান। অথচ বর্তমানে তিনি বিতর্কিত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবারও সেই বৈষম্যের পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছেন। সচেতন নাগরিক সমাজ প্রশ্ন তুলেছে, তিনি কোথায় পেলেন এই বাড়তি কোটার বৈধতা? পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন বা সংবিধানে এ ধরনের কোনো ধারা নেই। তাহলে এটি কি কেবল রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠীকে বারবার চাকরিতে প্রাধান্য দেওয়ার কৌশল নয়?

এই ধরনের বৈষম্যের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও তীব্র হবে, বাঙালি সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাকরি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে, নিয়োগে আস্থাহীনতা তৈরি হবে এবং রাষ্ট্রীয় ন্যায্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে সমান সুযোগ না থাকলে জাতীয় ঐক্য ক্ষুণ্ণ হবে এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। সমাধান একটাই, জাতীয় নীতিমালা অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে হবে, যাতে কোনো জনগোষ্ঠী বাড়তি সুবিধা না পায় এবং প্রত্যেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ পায়।

অতএব, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদকে এখনই এই বৈষম্যমূলক কোটার প্রথা বন্ধ করতে হবে। নিয়োগে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হলে ঘুষ-প্রশ্নফাঁস রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও গভীর হবে এবং রাষ্ট্রকে এর দায়ভার বহন করতে হবে। রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো সকল নাগরিককে সমানভাবে বিবেচনা করা, তা পাহাড়ে হোক বা সমতলে।

উল্লেখ যে, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ গত ১২ জুন ২০২৫ তারিখে চাকরি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন, যেখানে উপজাতি বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, কেন কর্তৃত্ববিহীন ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না। রিট আবেদনটি করেন, খাগড়াছড়ি সদরের বাসিন্দা মোঃ আসাদ উল্লাহ। গত ৩১ জুলাই বৃহস্পতিবার শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি ফয়েজ আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯-এর ধারা ৩২(২) ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালার ৪(২) কেন সংবিধানবিরোধী ঘোষণা করা হবে না। এছাড়াও গত ১২ আগস্ট ২০২৫, তীব্র সমালোচনার মুখে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার হেডম্যান প্রতিবেদনের বাধ্যতামূলকতার পক্ষে দেওয়া বিতর্কিত চিঠি প্রত্যাহার করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চেয়ে ২৯ জুলাই ২০২৫ তারিখে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, আদালতের রায় অনুযায়ী জমি হস্তান্তরের অনুমোদনের ক্ষেত্রে হেডম্যানের প্রতিবেদন ছাড়া পূর্বানুমোদন দেওয়া হলে ভূমি-সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হতে পারে। এতে হেডম্যান প্রতিবেদনকে অপরিহার্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যা স্থানীয় ব্লগার, নিউজ পোর্টাল, বাঙালি সংগঠন ও আইনজীবীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। পরে চিঠিটি প্রত্যাহার করতে বাধ্যহন কাজল তালুকদার।

আগের পোস্টখাগড়াছড়ি আসনে ওয়াদুদ ভূঁইয়ার নেতৃত্বে শান্তি-সম্প্রীতি ও উন্নয়নের প্রত্যাশা।
পরের পোস্টরাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর অভিযানে জেএসএস সদস্য অস্ত্রসহ আটক।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন