উপজাতি বনাম আদিবাসী: এনজিও ফান্ডিং-এর প্রভাব ডাকসু নির্বাচনে।

0

হান্নান সরকার

বাংলাদেশে “আদিবাসী” শব্দের ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। একদিকে রয়েছে সংবিধান, পার্বত্য চুক্তি ও ব্রিটিশ শাসনবিধি, যেখানে “উপজাতি”, “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী” বা “জাতিসত্তা” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে রয়েছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা, এনজিও এবং কিছু বাম রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও সুশীল সমাজ, যারা “আদিবাসী” শব্দকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ফান্ডিং, কর্মসূচি ও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিষয়টি কেবল ভাষাগত বা পরিচয়ের প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে।

সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান নিয়ে আলোচনা করবো:

২০১১ সালে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২৩(ক) যুক্ত করা হয়। এতে বলা হয়েছে,
“রাষ্ট্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, উপজাতি, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”

অর্থাৎ, রাষ্ট্র “আদিবাসী” শব্দ ব্যবহার না করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও উপজাতির স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একইভাবে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, এবং বৃটিশ প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (৫২) ধারা সব ক্ষেত্রেই “উপজাতি” শব্দই ব্যবহৃত হয়েছে।

২০১৯ সালে এনজিও ব্যুরো থেকে একটি চিঠি জারি হয়, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, “বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসী নামে কোনো জনগোষ্ঠী চিহ্নিত হয়নি”। পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়, আদিবাসী শব্দটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। সেই কারণে আদিবাসী নামধারী এনজিওগুলোর নাম পরিবর্তনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

২০২২ সালের ৯ আগস্ট তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রেও স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয় যে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে “আদিবাসী” শব্দ ব্যবহার না করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সরকার ২০০৮ সাল থেকেই এ ধরনের নির্দেশনা দিয়ে আসছে।

এনজিও, ফান্ডিং ও আন্তর্জাতিক প্রভাব কতটুকু?

যদিও সংবিধান “আদিবাসী” শব্দকে স্বীকৃতি দেয়নি, তথাপি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলো বিপুল অর্থ ঢেলে চলেছে। কারণ “Indigenous” পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ তহবিল ও রাজনৈতিক সুবিধা যুক্ত হয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক এনজিও ও ফান্ডিং উদাহরণ:
১. IWGIA – ড্যানিশ পররাষ্ট্র দফতরের অর্থায়নে ৭২ মিলিয়ন ডেনিশ ক্রোনার বাজেট পেয়েছে (২০২৪–২০২৭ মেয়াদে)।
২. Cultural Survival – “Keepers of the Earth Fund” ও “Indigenous Community Media Fund” এর মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
৩. Survival International – আদিবাসী ভূমি অধিকার ও স্ব-নির্ধারণের দাবিতে ক্যাম্পেইন চালায়।
৪. Rainforest Foundation Fund – জমির স্বীকৃতি ও বনাঞ্চল রক্ষায় অর্থ ও আইনি সহায়তা প্রদান করে।

বাংলাদেশভিত্তিক সংগঠন:

CCDB – প্রতিবছর প্রায় $3.5 মিলিয়ন দান পায় এবং আদিবাসী উন্নয়ন প্রকল্প চালায়।

SONNE-International – পাহাড় ও সীমান্ত এলাকায় শিক্ষা, হোস্টেল ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালাচ্ছে।

Kapaeeng Foundation – কাপেং ফাউন্ডেশন (Kapaeeng Foundation) হলো একটি তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা যা ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থাটির মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার সুরক্ষা ও প্রসার করা এবং সামাজিক ন্যায়, সমতা ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। তারা স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অ্যাডভোকেসি, লবিং ও প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের স্ত্রী ইয়েন ইয়েনের নেতৃত্বে আদিবাসী মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

এগুলো ছাড়াও মিশনারি ও মানবাধিকার ভিত্তিক একাধিক সংস্থা আন্তর্জাতিক অর্থায়নের মাধ্যমে উপজাতিদের “আদিবাসী” রূপে উপস্থাপন করছে।

আন্তর্জাতিক আইন: ILO কনভেনশন ১০৭ ও ১৬৯ কি বলে?

আদিবাসী শব্দের আন্তর্জাতিক আইনি প্রেক্ষাপট বোঝা জরুরি।

১. ILO Convention 107 (1957): প্রথম দলিল, যেখানে “Indigenous and Tribal” উভয় জনগোষ্ঠীর অধিকার উল্লেখ ছিল। তবে এতে কিছুটা পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকায় পরবর্তীতে সমালোচিত হয়।

২. ILO Convention 169 (1989): ১০৭-এর সংশোধিত রূপ। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:

“Indigenous” হলো প্রথম উপনিবেশ বা ভৌগলিক অবস্থান নির্ধারণের আগে থেকে কোনো ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী।

“Tribal” হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর থেকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভিন্ন জনগোষ্ঠী।

বাংলাদেশের পার্বত্য জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিকভাবে ১৭শ শতকের পর ভারত, মিয়ানমার ও তিব্বত থেকে অভিবাসিত হয়ে এসেছে। ফলে তারা ILO 169 অনুসারে “Tribal” পরিচয়ের সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সুবিধা ও অর্থায়নের জন্য কৌশলগতভাবে “Indigenous” পরিচয় দাবি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের উপজাতিদের ইতিহাস ও উৎপত্তি সম্পর্কে:

চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, পাংখোয়া, লুসাই, খুমি, তংচঙ্গ্যা—সবাই তিব্বত-বর্মা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। ইতিহাসে দেখা যায়, তারা ভারত ও মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধাপে ধাপে অভিবাসন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। অর্থাৎ তারা বাংলাদেশের ভেতরকার বাঙালিদের মতো আদি জনগোষ্ঠী নয়, বরং বহিরাগত শাখা।

২০০৭ সালের পর হঠাৎ “আদিবাসী” দাবির উত্থান কেন?

১. UNDRIP (2007): জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার সম্পর্কিত ঘোষণাপত্র অনুমোদন করলে আন্তর্জাতিক তহবিল, ভূমি অধিকার ও বিশেষ সুবিধার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
২. কৌশলগত পরিচয় পরিবর্তন: আগে যারা “উপজাতি” পরিচয় দিত, তারা এখন “আদিবাসী” দাবি করছে।
৩. ILO 169-এর উপজাতি অংশ এড়িয়ে যাওয়া: তারা শুধু Indigenous অংশ ব্যবহার করছে, Tribal অংশ এড়িয়ে যাচ্ছে যাতে তাদের অভিবাসী উৎস প্রকাশ না পায়।

শিক্ষাঙ্গনে আদিবাসী শব্দ ব্যবহারে বাধ্য করা হচ্ছে:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে উপজাতি শিক্ষার্থীরা “আদিবাসী” শব্দ ব্যবহার চাপিয়ে দিচ্ছে। ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থীদের জোরপূর্বক আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়েছে। এমনকি হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করলে ভোটদানে বিরত থাকবে। এমন বিষয়ে সংবাদসম্মেলন করেছে উপজাতিদের মধ্য হইতে উগ্র অংশ। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের ৯৯% এর বেশি মানুষ বাঙালি মুসলিম-হিন্দু, সেখানে ১% এরও কম জনগোষ্ঠী কীভাবে এমন চাপ সৃষ্টি করে? এর পেছনে কারা অর্থায়ন করছে, তা স্পষ্টভাবেই এনজিও ও দাতাসংস্থার ফান্ডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত।

আদিবাসী ইস্যুতে সক্রিয় ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে আমাদের ওয়াকিবহাল হওয়া উচিত নয় কী?

বাংলাদেশে আদিবাসী পরিচয় প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন বাম ঘরানার এবং এনজিও-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হলেন,
খুশি কবির, সুলতানা কামাল, মেজবাহ কামাল, রুবাইয়েত ফেরদৌস, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, জোবাইদা নাসরীন, অলিউর সান, সৈকত আরিফ, সন্তু মারমা, সঞ্জীব দ্রং, ফজলে হোসেন বাদশা, রুহিন হোসেন প্রিন্স, দেবাশীষ রায় ও ইয়েন ইয়েন রাখাইন, শিশির চাকমা, নিরুপা দেওয়ান, নিকোলাস চাকমা, মুক্তা বাড়ৈ, নাইম হাজং, অলীক, মেঘমল্লার বসু প্রমুখ।

বাংলাদেশের সংবিধান ও পার্বত্য চুক্তি তথা জেলা পরিষদ আইন স্পষ্টভাবে “আদিবাসী” শব্দকে অস্বীকার করেছে এবং “উপজাতি” ও “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী”কে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক এনজিও, দাতাসংস্থা এবং বামপন্থী সুশীল সমাজ বিপুল অর্থায়নের মাধ্যমে “আদিবাসী” পরিচয় চাপিয়ে দিচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসী হওয়া সত্ত্বেও পার্বত্য জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে সৃষ্ট আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নদাবাদী সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধার জন্য কৌশলগতভাবে নিজেদের “আদিবাসী” দাবি করছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও জাতীয় ঐক্য প্রশ্নের মুখে পড়ছে।

সুতরাং বাংলাদেশে উপজাতিদের সাংস্কৃতিক অধিকার, উন্নয়ন ও স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলেও “আদিবাসী” শব্দ চাপিয়ে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা রাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগজনক।

আগের পোস্টরাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর অভিযানে জেএসএস সদস্য অস্ত্রসহ আটক।
পরের পোস্টবিএসএফ মহাপরিচালকে ক্ষমা চাইতে হবে: সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা পরিষদ।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন