ডাকসু প্রাঙ্গণে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন সমর্থিত  প্রার্থীদের মুখোশ-রাজনীতি।

0

ঢাকা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম যৌথ প্রতিবেদক:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি বরাবরই জাতির সামগ্রিক রাজনীতির ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। এখানে নেতৃত্বের উত্থান-পতন শুধু ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা বিস্তৃত হয় জাতীয় পরিসরে। সাম্প্রতিক সময়ে খাগড়াছড়ি পানছড়ি উপজেলার তরুণী হেমা চাকমা সেই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন। তিনি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী (সেশন ২০২০-২১)। রাজনৈতিক অবস্থান ও পরিচয়ের আমূল রূপান্তর ঘটিয়ে তিনি নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-র কার্যনির্বাহী সদস্য পদে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

একসময় তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক উপ-সম্পাদক, কিন্তু এখন তাঁর বক্তৃতা, দাবি ও ইশতেহারে ফুটে উঠছে ‘আদিবাসী অধিকার’-নির্ভর স্লোগান। এই রূপান্তরই বহুমাত্রিক প্রশ্ন উত্থাপন করছে। কারণ, যিনি দীর্ঘদিন শাসকদলের ছাত্রসংগঠনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, হঠাৎ করে তাঁর সুরে সুরে ফুটে উঠছে সুশীল, মানবাধিকারমুখী বাগ্মিতা—এ যেন রাজনৈতিক সুবিধাবাদের প্রকট উদাহরণ।

পারিবারিক ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার:

হেমা চাকমার শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় পানছড়ি উপজেলার ২নং চেঙ্গী ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অনিল চন্দ্র চাকমার মেয়ে। অনিল ছিলেন ইউপিডিএফ সমর্থিত জনপ্রতিনিধি। তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্রম বরাবরই বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনার সাথে মিশ্রিত ছিল। ফলে সহজেই অনুমেয়, হেমার শৈশব-কৈশোরে সেই প্রভাব প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল। একই সঙ্গে অভিযোগ আছে, হেমা চাকমা একসময় ইউপিডিএফ-ঘনিষ্ঠ সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।

এই পারিবারিক ও সাংগঠনিক উত্তরাধিকার তাঁকে ‘আদিবাসী প্রতিনিধি’ হিসেবে পরিচিত হতে সহায়তা করেছে। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছাত্রলীগের প্রভাবশালী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ফলে তাঁর হঠাৎ করে আদিবাসী ইস্যুভিত্তিক প্রার্থী হয়ে ওঠা নিছক আদর্শিক নয়, বরং কৌশলগত রূপান্তর।

ইউপিডিএফ সহযোগী অঙ্গসংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নারী টিমের সঙ্গে হেমা চাকমা: এই নারী নেত্রীরা বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশের উপর হামলা করেছে।

নির্বাচনি ইশতেহার : সুশীল বচন না রাজনৈতিক রঙিন ক্যানভাস?

হেমার ফেসবুক পোস্টে দেখা যায়, তিনি বহুত্ববাদ, গণতান্ত্রিক অধিকার, শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, স্বাস্থ্যবীমা সচেতনতা, স্যানিটেশন, আবাসন সংকট, গণরুম ইত্যাদি ছাত্রজীবনের জ্বলন্ত ইস্যুতে সক্রিয় ছিলেন বলে দাবি করেছেন।

তবে এখানে প্রশ্ন জাগে—যিনি এতদিন শাসকদলের ছাত্রসংগঠনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন, তাঁর আকস্মিকভাবে আদিবাসী প্রতিনিধিত্বের দাবি কি নিছক ‘রাজনৈতিক রঙিন ক্যানভাস’ নয়? বিশ্লেষকরা মনে করেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলধারার রাজনীতিতে সুবিধা না পেয়ে এখন সংখ্যালঘু ইস্যুকে পুঁজি করছেন।

ছাত্রলীগের কমিটিতে হেমা চাকমা

পাহাড়ি তিন মুখ, ডাকসু নির্বাচনে নতুন সমীকরণ:

  • এবারের ডাকসু নির্বাচনে পাহাড় থেকে তিনজন নারী প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন:
    ১. রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তংচঙ্গ্যা – জেএসএস ও এনসিপি সমর্থিত, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক পদপ্রার্থী।
    ২. হেমা চাকমা – আওয়ামীলীগ ও ইউপিডিএফ-ঘনিষ্ঠ, কার্যনির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী।
    ৩. সুর্মী চাকমা – রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী, কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদপ্রার্থী, কথিত আছে তিনি ইউপিডিএফ সমর্থিত।

এই তিনজনের মধ্যে দুজন প্রকাশ্যে ‘আদিবাসী’ শব্দ ও অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার। তাদের কার্যক্রমকে অনেকে সংবিধানবিরোধী বলে চিহ্নিত করছেন। বিশেষত রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তংচঙ্গ্যা জেএসএস সন্তু লারমার ঘনিষ্ঠ এবং বিভিন্ন বাঙালি-বিরোধী কার্যক্রমে সক্রিয়।

সমালোচনা ও বিতর্ক:

ডাকসু প্রার্থী ফাতিমা তাসনিম জুমা প্রকাশ্যে হেমাকে সমালোচনা করে লিখেছেন—“এতো গলার জোরের শক্তি তাহলে জয় বাংলা স্লোগান।” তিনি হেমাকে শিবিরঘেঁষা হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই বক্তব্য নতুন এক বিতর্ক উসকে দেয়।

অন্যদিকে ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক সচেতনরা মনে করিয়ে দেন, চাকমা সার্কেল চীফ ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী করে পুরস্কৃত করেছিল। ফলে চাকমাদের দেশদ্রোহী ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই অস্বস্তিকর সত্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। হেমা ও রুপাইয়া সেখানে ফাতিমা তাসনিম জুমাসহ সমালোচকদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছেন।

উপজাতি নেতৃবৃন্দ ও সন্ত্রাসী সংযোগ:

কেবল হেমা নন, সাম্প্রতিক কালে বেশ কয়েকজন উপজাতি তরুণ-তরুণী জাতীয় রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করেছেন। তাদের অনেকে পারিবারিকভাবে ইউপিডিএফ বা জেএসএস সন্ত্রাসীদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।

উদাহরণস্বরূপ, বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের ক্রীড়া সম্পাদক পদপ্রার্থী চিম চিম্যা চাকমা ইউপিডিএফ সশস্ত্র কমান্ডার রঞ্জন মনি ওরফে আদি বাবুর ছেলে। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অনেকে ‘বাবার উত্তরাধিকার’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন।

ছাত্রদলের কমিটিতে ইউপিডিএফ সশস্ত্র গ্রুপ কমান্ডারের ছেলে চিম চিম্যা চাকমা

এমনকি বিভিন্ন বাম সংগঠন, এনজিও ও আন্তর্জাতিক ফান্ডিংয়ের সাথে যুক্ত হয়ে এসব প্রার্থী ‘আদিবাসী শব্দ’কে প্রচার করছে। এর মাধ্যমে তারা শুধু রাজনৈতিক মূলধন নয়, অর্থনৈতিক সুবিধাও অর্জন করছে।

সমকালীন বিশ্লেষণ,  পলিসি ও জাতীয় নিরাপত্তা:

পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু দশক ধরে সশস্ত্র আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী স্লোগান ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম চলমান। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক রাজনীতিতেও সেই ছায়া প্রবল হচ্ছে।

  • ১. রাজনৈতিক পটপরিবর্তন – সুবিধা অনুযায়ী ছাত্রলীগ থেকে সুশীল ও ইউপিডিএফ-ঘেঁষা পরিচয়ে রূপান্তর।
    ২. আদিবাসী শব্দের অপপ্রয়োগ – আন্তর্জাতিক ফান্ড ও মিডিয়া মনোযোগ কুড়ানোর কৌশল।
    ৩. জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি – সন্ত্রাসী পরিবার থেকে আগত তরুণ-তরুণীরা রাজনীতিতে প্রবেশ করলে তাদের অঘোষিত উদ্দেশ্য হতে পারে সংগঠনগুলোর স্বার্থ রক্ষা।
    ৪. সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব – ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং জাতীয় ঐক্য রক্ষায় সোচ্চার হওয়া।

হেমা চাকমার ডাকসু প্রার্থী হওয়া নিছক ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি রাজনীতির নতুন কৌশলের প্রতিফলন। একদিকে ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেত্রী, অন্যদিকে আদিবাসী অধিকারের সুশীল মুখোশ—এই দ্বৈত পরিচয় তাঁকে রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, তিনি কি সত্যিই ছাত্রস্বার্থের প্রতিনিধি, নাকি পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনের মুখপাত্র? তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, সংগঠনভিত্তিক সংযোগ ও হঠাৎ বচন-বদল সেই প্রশ্নকে আরও জটিল করে তোলে।

অতএব, দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ ও বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে এ ধরনের প্রার্থীদের অতীত ও বর্তমান সমানভাবে খতিয়ে দেখা জরুরি। জাতীয় ইতিহাস ও নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো প্রকার আপোষ জাতির অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

আগের পোস্টপিসিসিপি’র রাঙামাটি জেলা কমিটি ঘোষণা।
পরের পোস্টNetra News-এর মিথ্যা বয়ান: কেএনএফ সন্ত্রাস আড়ালে সেনাবাহিনীকে দোষারোপ।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন