হান্নান সরকার
গত ৩১ আগস্ট ২০২৫ খ্রি. Netra News–এ প্রকাশিত “We always live in fear: In Bangladesh’s hills, army’s quiet war on a tiny Bawm nation” শীর্ষক সংবাদটি আসলে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন। প্রতিবেদনের রচয়িতা ছিলেন ‘Marzia Hashmi Momo এবং Denim Chakma’। এখানে সেনাবাহিনীর শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পদক্ষেপকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদকে আড়াল করা হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো, কেএনএফ একটি সংগঠিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী, যারা দেশী-বিদেশি সহায়তায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
বান্দরবান রুমা ইডেন পাড়ার বাসিন্দা নাথান লনচেও বম প্রকাশ নাথান বমের নেতৃত্বে ২০০৮ সালে সামাজিক সংগঠন আকারে কেএনডি গঠনের মধ্য দিয়ে এ গোষ্ঠীর কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২০ সালের পর থেকে এটি কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে আত্মপ্রকাশ করে। মায়ানমারের কাচিন বিদ্রোহীসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছ থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তারা। পাশাপাশি ভারতের মিজোরাম রাজ্যে থাকা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নৈতিক সমর্থনও তারা পায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের নয়টি উপজেলা নিয়ে একটি স্বাধীন “কুকিল্যাণ্ড” রাষ্ট্র গঠন।
২০২২ সালে কেএনএফ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে তোলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সশস্ত্র ভিডিও, মানচিত্র, পতাকা ও দাবিদাওয়া প্রকাশের মাধ্যমে। একটি জঙ্গি গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে নিরাপত্তা বাহিনী ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর–অক্টোবর মাস থেকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা শুরু করে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ও ভাঙন:
অভিযান শুরু হওয়ার পর পাহাড়ে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে ২০২৩ সালের ৩০ মে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা মারমা। এই কমিটি প্রথমে কেএনএফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালায়।
রুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মুনলাই পাড়াতে কেএনএফ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মধ্যে দুটি সরাসরি বৈঠক হয়। এ বৈঠকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরাও প্রথমবারের মতো উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ভার্চুয়াল বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়।
কেএনএফ সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবিদাওয়া প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে ১১টি দাবি সরকার মেনে নেয় এবং বাকিগুলো উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়। এটি প্রমাণ করে, রাষ্ট্র কোনো দমননীতি নয় বরং শান্তিপূর্ণ সমাধান চাইছিল।
কিন্তু কেএনএফ প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে আবারও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। ২০২৪ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল তারা বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার সোনালী এ কৃষি দুটি ব্যাংকে ডাকাতি চালায়, ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে এবং পুলিশ-আনসার থেকে ১৪টি অস্ত্র লুট করে। এই ঘটনার পর কেএনএফকে সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর অভিযান শুরু হয়।
১৩ বছরের ছাত্র হত্যার প্রসঙ্গ:
Netra News প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ভ্যান থান পুই বম নামের এক ১৩ বছরের ছাত্রকে হত্যা করেছে। কিন্তু সরকারি ও স্থানীয় সূত্র ভিন্ন বাস্তবতা প্রকাশ করছে।
ঘটনাটি ঘটে ২০২৪ সালের ২৩ মে, যখন সেনাবাহিনী কেএনএফ-এর একটি আস্তানায় অভিযান চালায়। নিহত কিশোরটি ওই আস্তানাতেই উপস্থিত ছিল। স্থানীয় তথ্য বিশ্লেষণে ধারণা করা হয়, সে নিয়মিত কেএনএফ-এর রসদ সরবরাহ করত। তদন্তের আগে তাকে “নিরীহ ছাত্র” হিসেবে আখ্যায়িত করা নিছক প্রোপাগান্ডা।
Netra News সংবাদে বলা হয়েছে যে, বম জনগোষ্ঠীর শরণার্থী সংকট ও সেনাবাহিনী ছোট বম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা এই দাবির চেয়ে ভিন্ন।
অভিযানের সময় কেএনএফ স্থানীয় বম জনগোষ্ঠীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এর ফলে অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে স্থানীয় বনাঞ্চল বা প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, মিয়ানমার বা ভারতের মিজোরামে।
কেএনএফ এই বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটায় যাতে সেনাবাহিনীকে “মানবাধিকার লঙ্ঘনের” অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায়। প্রকৃত অপরাধী কেএনএফ, যারা লোকালয়ে মিশে বেসামরিক জনগণকে বিপদে ফেলে।
তাদের কার্যক্রমে সাধারণ বমসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চাল-ডাল, নিত্যপণ্য এবং গৃহপালিত পশুপাখি ছিনিয়ে নেওয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর ফলে বাজারের লেনদেন সীমিত হয়ে যায় এবং বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়ে।
যেহেতু কেএনএফ সন্ত্রাসীরা সাধারণ মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এবং তাদের ভয় দেখিয়ে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তাই তৎকালীন নিরাপত্তা বাহিনী স্থানীয়দের চলাফেরা, কেনাকাটা ও নিরাপত্তার ওপর নজর রাখে। এই অঞ্চলে কেএনএফ রাষ্ট্রের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছিল, স্থানীয়দের কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত করা, পর্যটন শিল্পে বাধা দেওয়া, পর্যটকদের উপর হামলা, অর্থ ও মোবাইল লুটপাট এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান। সব মিলিয়ে, কেএনএফ কার্যক্রম শান্তি বিনষ্টের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
আটক ও মৃত্যুর ঘটনা:
Netra News দাবি করেছে, বহু বম নারী-পুরুষ অন্যায়ভাবে আটক বা কারাগারে মারা গেছে। অথচ বাস্তব প্রেক্ষাপটে—
অধিকাংশ আটক ব্যক্তি কেএনএফ সদস্য বা সরাসরি সহযোগী কিংবা আশ্রয় প্রদানকারী। আটককৃত নারীরা কারাগারে গেলে সঙ্গে তাদের ছোট্ট শিশুরা থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু শিশুদের কারাগারে রাখার যে, অভিযোগ করা হয়েছে তা সত্য নয়। আর কারাগারে মৃত্যুর ঘটনা স্বাভাবিক রোগ বা বার্ধক্যজনিত কারণে, পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগ ভিত্তিহীন। তদন্ত প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে; নির্দোষ প্রমাণিত হলে মুক্তির সুযোগ রয়েছে।
অতএব, সব বন্দিকে নির্দোষ বলা যায় না।
সেনাবাহিনীর ভূমিকা:
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সংবেদনশীল এক ভূখণ্ড। এখানে যখন কেএনএফ-এর মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন অস্ত্রের মাধ্যমে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, তখন রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা।
কেএনএফ-এর লাগাতার চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুম এবং পর্যটকদের ওপর হামলায় বান্দরবানের সাধারণ মানুষ হতাশা ও ভয়ের গভীরে নিমজ্জিত হয়েছিল। সেই কঠিন সময়ে সেনাবাহিনী এগিয়ে এসে তাদের নিরাপত্তার ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।
এমনকি কেএনএফ-এর অতর্কিত হামলায় সাত সেনাসদস্য শহীদ হওয়ার পরও সেনাবাহিনী প্রতিশোধপরায়ণ হয়নি। বরং মানবাধিকার সমুন্নত রেখে এবং আইনের শাসনের পথ অনুসরণ করেই তারা পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।
যারা বলেন, সেনাবাহিনী পাহাড়ে কী করেন? তাদের জানা উচিত—
সেনাবাহিনী শুধু অভিযান চালাচ্ছে না, বরং ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) মধ্যকার সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের শর্ত হিসেবে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ও আলোচনায় সরাসরি অংশ নিয়েছে। তারা পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা, উন্নয়ন, শিক্ষা ও মানবিক সহায়তা একসাথে পরিচালনা করছে।
Netra News–এর প্রোপাগান্ডা:
- প্রতিবেদনটিতে কয়েকটি কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে—
১. নিহত বা আটক সবাইকে নির্দোষ বেসামরিক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
২. কেএনএফ-এর সন্ত্রাস, ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুট, মসজিদে হামলা, এসব উল্লেখ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
৩. সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল পদক্ষেপকে “সমষ্টিগত শাস্তি” হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
৪. আন্তর্জাতিক মহলকে বিভ্রান্ত করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কেএনএফ কোনো সামাজিক আন্দোলন নয়, এটি একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। তারা বিদেশি সহায়তায় স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্র করেছে। ২০২২ সালে অভিযান শুরু হওয়ার পরও সরকার শান্তি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেএনএফ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুট করে। বম জনগোষ্ঠীকে ঢাল বানিয়ে সাধারণ মানুষকে শরণার্থী করে সেনাবাহিনীকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছে।
Netra News–এর প্রতিবেদন আসলে কেএনএফ-এর অপরাধ আড়াল করে বিদেশি মহলে বাংলাদেশকে বিভ্রান্ত করার একটি অপচেষ্টা। সুতরাং সত্যকে সামনে আনতে হলে আমাদের দায়িত্ব, প্রকৃত প্রমাণ ও ঘটনাবলি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা।